Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

পরীক্ষা এড়িয়ে কলকাতা বলে সেরা স্বচ্ছ আমিই

গোটা দেশে স্বচ্ছতার তালিকায় আসানসোল তলানিতে। আর কলকাতা কোথায়! কেন্দ্র বলছে, এ বছর পরীক্ষাতেই বসেনি কলকাতা।এড়িয়ে গিয়েছে। তবে কী ফাঁক ছিল প্রস্তুতিতে? সে কারণেই কি পরীক্ষায় ‘ড্রপ’ দিল কলকাতা? কেন্দ্রের মন্ত্রী বলছেন, কারণটা রাজ্য সরকারই জানে।

শঙ্খদীপ দাস
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:৩৬
Share: Save:

গোটা দেশে স্বচ্ছতার তালিকায় আসানসোল তলানিতে। আর কলকাতা কোথায়! কেন্দ্র বলছে, এ বছর পরীক্ষাতেই বসেনি কলকাতা। এড়িয়ে গিয়েছে।

তবে কী ফাঁক ছিল প্রস্তুতিতে? সে কারণেই কি পরীক্ষায় ‘ড্রপ’ দিল কলকাতা? কেন্দ্রের মন্ত্রী বলছেন, কারণটা রাজ্য সরকারই জানে। অনেকেই মনে করছেন প্রশ্নটা সম্ভবত প্রস্তুতির নয়। এটা ঘটনা যে, সেই বড়দিনের সময় থেকে নীল-সাদা আলোয় সেজে রয়েছে কলকাতা! সেতু, উড়ালপুল, বড় রাস্তা, ত্রিফলার থাম পেঁচিয়ে বিকেল গড়ালেই জ্বলে উঠছে এলইডি-চেন! কোথাও বা রাস্তা দখল করে রাতারাতি গজিয়ে উঠেছে লন্ডনের বিগ বেনের আদলে ফাইবার গ্লাসের কাঠামো! রাস্তার ডিভাইডারে বাহারি বাগান! সাফসাফাইয়েও কম লোকের নাম নেই একশো দিনের কাজে। তবু স্বচ্ছতার তালিকায় কলকাতা ঠিক কোথায়, সেটা জানার কোনও উপায় আপাতত নেই।

কী বলছেন রাজ্যের নেতা-মন্ত্রীরা?

তাঁদের বক্তব্য, কলকাতা পরীক্ষায় বসতে যাবে কোন দুঃখে! পরীক্ষা যারা নিচ্ছে, তারাই বরং স্বচ্ছতা নিয়ে ময়দানে নেমেছে কলকাতার ঢের পরে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় বাংলা এ ব্যাপারেও পথ দেখাচ্ছে দেশকে। মোদ্দা কথায় রাজ্যের শাসক শিবির মনে করে, স্বচ্ছতার পরীক্ষায় কলকাতা আগে থেকেই পাশ!

বিরোধীরা কিন্তু বলছেন, সামনে বিধানসভা নির্বাচন। অস্বস্তিতে পড়তে হতে পারে ভেবেই হয়তো স্বচ্ছতা-সমীক্ষার পরীক্ষায় কলকাতাকে বসাতেই চায়নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার! কিন্তু রাজ্যের অস্বস্তি কি তাতে আদৌ কমেছে? স্বচ্ছতার পরীক্ষায় বসে যে ডাহা ফেল করল আসানসোল! শেষ থেকে এক নম্বর জায়গাটি দখল করে বাংলার মুখ রেখেছে পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ড। স্বচ্ছতার ক্লাসে ‘লাস্ট বয়’ ধানবাদ। আর শেষ থেকে দু’নম্বরে আসানসোল। পরিচ্ছন্নতার পরীক্ষায় আসানসোল পেয়েছে ২৪.৮৫% নম্বর। ধানবাদ টেনেটুনে ২৩%।

কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পরেই নরেন্দ্র মোদীর সরকার ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’ শুরু করেছে। সেই প্রকল্পের আওতায় প্রথম বছরে রাজ্যওয়াড়ি কিছু অনুদান দেয় কেন্দ্র। তার পর বছর ঘুরতে শুরু হয় স্বচ্ছতার পরীক্ষা নেওয়ার পালা। কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রক গোড়ায় স্থির করেছিল দেশের রাজধানী শহরগুলি ও তার সঙ্গে জনসংখ্যা ১০ লক্ষের বেশি এমন ৫৩টি ছোট শহরকে নিয়ে এই সমীক্ষা হবে। কলকাতা ও উত্তরপ্রদেশের নয়ডা প্রতিযোগিতা থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেয়। প্রতিযোগিতা হয় মোট ৭৩টি শহরের মধ্যে। চূড়ান্ত ফলাফলে আজ দেখা যাচ্ছে, প্রথম দশে রয়েছে, মহীশূর, চণ্ডীগড়, তিরুচিরাপল্লি, নয়াদিল্লি পুরসভা এলাকা, বিশাখাপত্তনম, সুরত, রাজকোট, গ্যাংটক, পিমপ্রি-ছিন্দওয়াড়, বৃহন্মুম্বই!

কলকাতা কেন এড়িয়ে গেল এই প্রতিযোগিতা? কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডু এই প্রশ্নে বলেন, ‘‘কলকাতা জানিয়েছে, তারা এই দফায় অংশ নিতে চায় না। আগামী বছর তারা পরীক্ষায় বসবে। কেন তারা এ বারের প্রতিযোগিতা এড়িয়ে গেল, রাজ্য সরকারই তার ব্যাখ্যা দিতে পারবে।’’

রাজ্যের নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘‘এমন কোনও সমীক্ষার কথা দফতরের জানা নেই। পুরসভাগুলিকে সরাসরি কিছু জানিয়ে থাকলে আলাদা বিষয়। আসানসোল নিয়েও কী হয়েছে জানি না।’’

ফিরহাদ বলটা না খেললেও, ব্যাট হাঁকিয়েছেন কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। তিনি জানিয়ে দেন, এই প্রতিযোগিতায় যোগদানের কোনও কারণই নেই। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘মোদী সরকার স্বচ্ছতা অভিযান শুরু করেছে ২০১৪ সালে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১০ সালেই কলকাতা পুরসভায় স্বচ্ছতা অভিযান কর্মসূচি গ্রহণ করার কথা বলেছেন। এই শহর পরিষ্কার রাখার যে নীতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা পুরসভাকে দিয়ে গ্রহণ করিয়েছেন, সেটাই আজকের স্বচ্ছ ভারত অভিযানের মূল উদ্দেশ্য। পরে এটাই অনুকরণ করেছে দিল্লি।’’ মেয়রের দাবি, ‘‘শহর বদলে গিয়েছে। কলকাতার এখন আর কোনও পরীক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং দেশের কাছে কলকাতার সৌন্দর্যায়নই মডেল হওয়া উচিত। পরিচ্ছন্নতা অভিযানে কলকাতা ভারতের অন্যতম পথপ্রদর্শক। শহর স্বচ্ছ রাখার মতো বাংলার কন্যাশ্রী প্রকল্পও দেশের অন্যতম নিদর্শন। যা এখন দেশের অন্যত্র করার চেষ্টা হচ্ছে।’’

আসানসোলের দুর্দশায় ক্ষুব্ধ কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী, তথা আসানসোলের সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়। আজ তাঁকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করতেই বললেন, ‘‘আসানসোল শেষ থেকে দ্বিতীয় দেখেই লজ্জা হচ্ছে! কিন্তু কী করব! আমার হাত পা বাঁধা! পুরসভা রাজ্যের কথা শুনে চলে। পইপই করে বলা সত্ত্বেও কোনও সহযোগিতা করল না রাজ্য সরকার! স্বচ্ছতা প্রকল্পে কেন্দ্র থেকে টাকা পেয়েও আসানসোলকে তা দেয়নি রাজ্য সরকার।’’ বাবুলের কথায়, ‘‘কলকাতা কেন সমীক্ষায় অংশ নিল না তা কোনও শিশুও বুঝবে। ভোটের আগে অস্বস্তি এড়াতে চাইল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। সমীক্ষাটি এড়িয়ে যাওয়ার কোনও প্রশাসনিক কারণ ছিল না। কেননা স্বচ্ছতা প্রকল্পে রাজ্য সরকার কেন্দ্র থেকে গত বছর ৬৪ কোটি টাকা পেয়েছে।’’

আসানসোলের মেয়র জিতেন্দ্র তিওয়ারি কিন্তু পাল্টা আঙুল তুলছেন স্থানীয় সাংসদ বাবুলের দিকেই। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আসানসোলকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, তা আমরা বুঝি। সে জন্য আমরা ‘ক্লিন আসানসোল, গ্রিন আসানসোল’ কর্মসূচি নিয়েছি। কাজও শুরু হয়েছে। কিন্তু এই কর্মসূচিতে সাংসদের যে ভূমিকা থাকা উচিত ছিল, তা দেখা যাচ্ছে না। এর জন্য কেন্দ্রের কাছে যে অনুদান পাওয়া উচিত ছিল, তা-ও আমরা পাইনি। তবে এ সব অসহযোগিতার সত্ত্বেও শীঘ্রই আমরা ওই তালিকায় প্রথম দশের মধ্যে উঠে আসব।’’

যদিও এ ব্যাপারে বাবুলের সঙ্গে একই সুরে আজ মমতা সরকারকে বিঁধেছেন অন্য বিরোধীরা। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, কলকাতাকে লন্ডন বানিয়ে দেবেন। এখন পরীক্ষা দিতে ভয় পাচ্ছেন কেন? আসলে তিনি জানেন, তৃণমূলের লোকেরা ও তাদের সিন্ডিকেট বাহিনী কলকাতাকে লন্ডন নয় লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। ভোটের আগে শহরের স্বচ্ছতার হাল ফাঁস হয়ে গেলে ওঁর সরকার ও দলের মুখ পুড়বে বুঝেই পিছিয়ে গিয়েছেন।’’

এমন রাজনৈতিক চাপানউতোর চলবেই। তার বাইরে খুঁজে দেখা যাক এ যাত্রায় সমীক্ষার ফাঁড়া এড়াতে রাজ্য সরকারের তরফে কেন্দ্রকে কী যুক্তি দেওয়া হয়েছিল?

কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, সরকারি ভাবে নয়াদিল্লিকে এ জন্য নবান্ন কোনও চিঠি দেয়নি। শুধু মৌখিক ভাবে জানিয়ে দেয়। নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের যুগ্মসচিব প্রবীণ প্রকাশ এ ব্যাপারে রাজ্যের মুখ্যসচিব, নগরোন্নয়ন দফতরের সচিব দেবাশিস সেন এবং কলকাতা পুরসভার কমিশনারকে ফোন করে অনুরোধ করলেও তাঁরা রাজি হননি বলেই কেন্দ্রের অভিযোগ। সমীক্ষার ব্যাপারে রাজ্য সরকার যে এ ভাবে অসহযোগিতা করেছে সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী বাবুলকেও জানিয়েছেন প্রবীণ প্রকাশ।

মূলত ছ’টি মাপদণ্ডের ভিত্তিতে ৭৩টি শহরকে নিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছিল কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রক। মাঠেঘাটে মলমূত্র ত্যাগ বন্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, স্বচ্ছতার জন্য সচেতনতার প্রসার, বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বর্জ্য সংগ্রহ করা, বর্জ্য পদার্থের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা, সাধারণ শৌচাগার নির্মাণ ও প্রতিটি বাড়িতে শৌচাগারের ব্যবস্থা করা। এ ব্যাপারে বেঙ্কাইয়া এ দিন বলেন, ‘‘আসলে সরকারের উদ্দেশ্য হল স্বচ্ছতা নিয়ে শহরগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতার মানসিকতা তৈরি করা। এই মনোভাব ও প্রতিযোগিতা যত মজবুত হবে, সামগ্রিক ভাবে ততই স্বচ্ছ হবে ভারত। আশা করছি এ বার না হলেও আগামী রাউন্ডে পরীক্ষায় বসবে কলকাতা। আসানসোল ও ধানবাদও শুধরে নেবে ত্রুটি-বিচ্যুতি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE