Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

শব্দবাজি নিয়ে পুলিশের সঙ্গে লুকোচুরি মহানগরের

এ যেন শহরের রীতি হয়ে গিয়েছে! প্রতি বছরই কালীপুজোর রাতে শব্দবাজিতে লাগাম টানার জন্য কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করতে পুলিশ-দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। আর সেই কড়া নজর এড়িয়ে ‘চোর-পুলিশ’ খেলতে খেলতে শহরের বহু জায়গাতেই দাপট দেখাবে পটকা-বোমারা। এই ছবিটা দেখা গিয়েছিল গত বছর। এ বছরের অভিজ্ঞতাও একই! লালবাজার জানিয়েছে, এই লুকোচুরি খেলায় বৃহস্পতিবার মাঝ রাত পর্যন্ত ২৫৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তখনও দেদার ফাটছে শব্দবোমা। অভিযান চলে সারা রাতই।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায় ও শিবাজী দে সরকার
শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৪ ২৩:৩২
Share: Save:

এ যেন শহরের রীতি হয়ে গিয়েছে! প্রতি বছরই কালীপুজোর রাতে শব্দবাজিতে লাগাম টানার জন্য কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করতে পুলিশ-দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। আর সেই কড়া নজর এড়িয়ে ‘চোর-পুলিশ’ খেলতে খেলতে শহরের বহু জায়গাতেই দাপট দেখাবে পটকা-বোমারা।

এই ছবিটা দেখা গিয়েছিল গত বছর। এ বছরের অভিজ্ঞতাও একই! লালবাজার জানিয়েছে, এই লুকোচুরি খেলায় বৃহস্পতিবার মাঝ রাত পর্যন্ত ২৫৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তখনও দেদার ফাটছে শব্দবোমা। অভিযান চলে সারা রাতই।

শব্দবাজিতে লাগাম টানতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকেই পথে টহলদারি পুলিশ নামিয়েছিল লালবাজার। নজর রাখা হয়েছিল উড়ুক্কু যান (ড্রোন) দিয়েও। রাস্তায় নেমেছিল দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ন’টি দলও।

বিকেল পাঁচটা নাগাদ লালবাজারের এক কর্তা বলছিলেন, “এ বার আরও অনেক কড়া নজর রাখছি। আশা করি, তেমন বোমা-পটকা ফাটবে না।” তাঁর এই আশা কিন্তু খুব বেশি ক্ষণ টিকল না। ঘড়ির কাঁটা সবে সন্ধ্যা সাতটা পেরিয়েছে। শব্দবাজির অভিযোগ জানিয়ে একের পর এক ফোন আসতে শুরু করল লালবাজারের কন্ট্রোল রুমে। টানা ফোন বাজছিল দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সদর দফতর ‘পরিবেশ ভবন’-এর কন্ট্রোল রুমে। লালবাজার সূত্রের খবর, বড়বাজার, ফুলবাগান, কাশীপুর, গরফা বেহালা, বাঁশদ্রোণী, ই এম বাইপাস সংলগ্ন এলাকা থেকে শব্দবাজির অভিযোগ মিলেছে। পর্ষদের কাছে অভিযোগ গিয়েছে সল্টলেক, লেকটাউন, দমদম থেকে।

তবে পুলিশের একাংশের দাবি, কলকাতার অনেক জায়গায় শব্দবাজির দাপট আগের থেকে কমেছে। একই সুর পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদারের গলাতেও। তিনি বলেছেন, “রাজ্যবাসীকে ধন্যবাদ। শব্দবাজির দাপট এ বার অনেক কম।” সুদর্শনবাবু জানান, তিনি নিজে এ দিন বারাসত-মধ্যমগ্রাম এলাকা থেকে দক্ষিণ কলকাতা পর্যন্ত এসেছেন। শব্দবাজির দাপট সে ভাবে তাঁর চোখে পড়েনি বলেই জানান পরিবেশমন্ত্রী। তবে পুলিশ ও পরিবেশমন্ত্রী এ কথা বললেও শহরের অনেক বাসিন্দা বলছেন, কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় এ বছরও বোমা-পটকার দাপট ছিল একই রকম। পুলিশ টহল দিতে এলে কিছুক্ষণের জন্য থামছে। পুলিশ পাড়া ছেড়ে চলে গেলে ফের শুরু হয়েছে শব্দবাজি। লালবাজার সূত্রে জানা গিয়েছে, খবর পেয়ে বহু জায়গাতেই হানা দিয়েছে টহলদারি দলগুলি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই খালি হাতে ফিরতে হয়েছে তাদের। একই অবস্থা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অফিসারদেও! কেন?

পুলিশ ও পর্ষদ সূত্রের খবর, শহরের বিভিন্ন বহুতলের ছাদ এবং অলিগলিতে শব্দবাজি ফাটানো হচ্ছে। খবর পেয়ে পুলিশ পৌঁছনোর আগেই ‘বাজিকরেরা’ উধাও হয়ে গিয়েছে। রাত ন’টা নাগাদ মধ্য কলকাতার একটি ছাদে বোমা ফাটানোর আওয়াজ পেয়ে হানা দিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু সদর দরজা বন্ধ থাকায় ভিতরেই ঢুকতে পারেনি তারা। এক পুলিশ অফিসারের বক্তব্য, “বহুতলের নীচে পুলিশ হাজির হওয়ায় পটকা-বোমা ফাটানো বন্ধ হয়েছিল। আমরা কিছুটা দূরে সরতেই ফের কানে এল বোমার আওয়াজ!”

তবে পুলিশকর্তাদের দাবি, এ বার শহরের কিছু বহুতলের ছাদে হোমগার্ড মোতায়েন করা হয়। তাতে শব্দবাজির দাপটে কিছুটা লাগাম টানা গিয়েছে।

যদিও শহরের বাসিন্দাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা আলাদা কথা বলছে। রাত দশটা নাগাদ বছর সত্তরের এক বৃদ্ধ বললেন, “বোমার আওয়াজে বুধবার রাত থেকেই আমার পোষা কুকুরের নাজেহাল অবস্থা।”

গত বছর বাজির শব্দমাত্রা নিয়ে আদালতে মামলা থাকায় অনেক পরে বাজি ধরপাকড়ে নেমেছিল পুলিশ। তার ফলে প্রচুর শব্দবাজি শহরে ঢুকে পড়েছিল। এ বার অবশ্য আগে নামলেও পুলিশি নজর ‘এড়িয়ে’ বহু বাজিই শহরে ঢুকেছে। চোরাপথে দেদার বিকিয়েছে সেগুলি। “কালীপুজোর রাতে এই চোর-পুলিশ খেলাটা যে হবে, সেটা তখনই বোঝা গিয়েছিল,” মন্তব্য এক পুলিশকর্তার।

শব্দবাজিতে পুরোপুরি লাগাম টানা যে সম্ভব নয়, তা মেনেই নিচ্ছেন লালবাজার-কর্তারা। একই সঙ্গে তাঁদের দাবি, শহরের কোথাও শব্দবাজি বিক্রি হচ্ছে, এই খবর পেলেই গ্রেফতার করা হয়েছে। কালীপুজোর সন্ধ্যাতেও কড়া নজরদারি দিয়ে শব্দবাজিতে লাগাম টানার চেষ্টা হয়েছে। এ দিন কলকাতার বিভিন্ন এলাকা থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত ৮০০ কেজি শব্দবাজি আটক হয়েছে।

তবে শুধু কড়া নজরদারি দিয়েই শব্দবাজি বন্ধ করা যাবে না বলে দাবি করেছেন পুলিশ ও পর্ষদ কর্তারা। পর্ষদের এক বিজ্ঞানী বলছেন, “শব্দবাজি বন্ধ করতে গেলে মানুষের সচেতনতা জরুরি।” সাধারণ মানুষ যে শব্দবাজির প্রতি আকৃষ্ট, তা জানিয়েছেন বাজি ব্যবসায়ীরাও। সারা বাংলা আতসবাজি উন্নয়ন সমিতির চেয়ারম্যান বাবলা রায় বলছেন, “এখনও লোকে বাজি বাজারে এসে শব্দবাজি খোঁজে। আতসবাজির জৌলুস বাড়লেও শব্দবাজির চাহিদা কিন্তু কমেনি।”

শুধু বাজি নয়, অন্যান্য বছরের মতো এ বারও কালীপুজোর সন্ধ্যা থেকেই শহরের বিভিন্ন প্রান্তে অগ্নিকাণ্ডের খবর মিলেছে। তবে রাত পর্যন্ত কোনও হতাহতের খবর মেলেনি। দমকল জানিয়েছে, সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা নাগাদ বাইপাস সংলগ্ন অজয়নগরে একটি বহুতলের সাততলার ফ্ল্যাটে বাজি থেকে আগুন লাগে। একটি ইঞ্জিন গিয়ে আগুন নেভায়। এর আধ ঘণ্টার মধ্যেই বাঁশদ্রোণীর পূর্বাশা পার্ক কালীমন্দিরের পাশে একটি বাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে আগুন লাগে। একটি ইঞ্জিন ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়।

রাত আটটা নাগাদ ডানলপের অশোকগড়ের একটি বাড়িতে বাজি থেকে আগুন লাগে। সেখানেও একটি ইঞ্জিন গিয়ে আগুন নেভায়। রাত দশটা নাগাদ বড়বাজারের এক গুদামে আগুন লাগে। ৪টি ইঞ্জিন ঘটনাস্থলে যায়।

দমকল বলছে, কালীপুজোর রাতে প্রতি বছরই ছোট-বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটে। সাধারণ আয়োজনের সঙ্গে এ বছর বিভিন্ন এলাকায় আরও আটটি জায়গায় দমকলের গাড়ি রাখা হয়েছিল।

কালীপুজোর আগের রাতে পাড়ায় দীপাবলির আলো লাগাতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে এক তরুণের। পুলিশ জানিয়েছে, বুধবার রাতে বালিগঞ্জ থানার বেলতলা রোডে বিদ্যুত্‌স্পৃষ্ট হয়ে শ্রীমন্ত হালদার (১৯) নামে এক তরুণের মৃত্যু হয়েছে।

তথ্য সহায়তা: অভীক বন্দ্যোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE