সারা ভারত-জুড়ে খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগের বিরুদ্ধে সরকারি প্রচার চলছে, তৈরি হচ্ছে কয়েক লক্ষ শৌচাগার। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও ঘোষণা করেছে, ২০১৯ সালের মধ্যে রাজ্যে খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ পুরোপুরি বন্ধ হবে। ইতিমধ্যে এ রাজ্যেও তৈরি হয়েছে ১২ লক্ষের বেশি শৌচালয়। অথচ এই পশ্চিমবঙ্গেই কলকাতার একেবারে পাশে হাওড়ার সালকিয়ায় ৫২ শয্যার এক সরকারি হাসপাতালের চিত্রটা একেবারে অন্য রকম। ডায়েরিয়া-আক্রান্ত রোগীরা এখানে কয়েক যুগ ধরে ওয়ার্ডের ভিতরেই শয্যার পাশে মাটিতে প্রকাশ্যে মলত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন!
এই ভয়ঙ্কর সত্যিটা তাঁদের এতদিন জানাই ছিল না বলে দাবি করেছেন স্বাস্থ্যকর্তারা! অথচ ৬৫ বছরের সত্যবালা আইডি হাসপাতালে আসা ডায়েরিয়া রোগীদের জন্য কখনও বেডপ্যান বা গামলার ব্যবস্থা হয়নি। ২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, খোলা জায়গায় মলত্যাগের জন্য বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ ডায়েরিয়া আক্রান্ত হয়ে মারা যান। শিশুদের মধ্যে এ জন্যই টাইফয়েড, কলেরা, হেপাটাইটিস, পোলিওর মতো রোগ ছড়ায়। সেখানে কিনা মূলত ডায়েরিয়ার চিকিৎসা হওয়া এক সরকারি আইডি হাসপাতালে রোগীদের মলমূত্র ত্যাগ করতে হচ্ছে ওয়ার্ডের ভিতরেই!
গত ১৩ জানুয়ারি দুপুরে সত্যবালা আইডি হাসপাতালে যাওয়ার পরে নার্স ও চিকিৎসকেরাই ওয়ার্ড দেখাতে নিয়ে গেলেন। বেশিরভাগ শয্যার পিছন দিকে দেওয়ালের নীচে একটি করে ফুটো। নার্সদের কথায়, ডায়েরিয়া রোগীদের বার বার মলত্যাগ করতে হয় এবং শরীর খুব দুর্বল থাকে, মাথা ঘোরে। তার উপরে হাতে স্যালাইনের নল লাগানো থাকে। তাঁদের পক্ষে উঠে শৌচাগারে যাওয়া সম্ভব হয় না। তাই তাঁদের বেডপ্যান দেওয়াই নিয়ম। কিন্তু সত্যবালা হাসপাতালে সরকার বেডপ্যান দেয় না। ফলে অসুস্থ রোগীরা ওয়ার্ডের মেঝেতেই মলমূত্র ত্যাগ করেন। পরে এক সময়ে জমাদার এসে জল ঢেলে পরিষ্কার করেন। দেওয়ালের ফুটোগুলি ওই জন্যই। বর্ষাকালে আবার নর্দমা ছাপিয়ে ওই ফুটো দিয়েই সব জল ওয়ার্ডে চলে আসে। স্বাস্থ্যভবনের উদ্দেশ্যে চিকিৎসক-নার্সদের প্রশ্ন —সভ্য জগতে কোনও হাসপাতালে কি এমনটা চলতে পারে?
স্বাস্থ্যভবনের কর্তাদের একাংশের মতে, কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সত্যবালা আইডি হাসপাতাল প্রথম থেকেই স্বাস্থ্য দফতরের কাছে ব্রাত্য হয়ে রয়েছে। নিকট অতীতেও স্বাস্থ্য দফতর থেকে কোনও কর্তা হাসপাতাল পরিদর্শনে আসেননি। হাসপাতালের অবস্থা নিয়ে মাথাও ঘামাননি কেউ। এ ব্যাপারে যত চিঠিচাপাটি হাসপাতালের তরফে হয়েছে, সবই স্বাস্থ্যভবনের চোখ এড়িয়ে গিয়েছে বলে তাঁদের অভিযোগ। এমনকী পূর্ত দফতরের খাতাতেও এই হাসপাতালের নাম তোলা হয়নি।
হাসপাতালের সুপার সুস্মিতা দাশগুপ্ত ঘোষের কথায়, ‘‘গ্রীষ্ম-বর্ষায় ৫২টি বেডের মধ্যে গড়ে ৪২-৪৩ জন করে রোগী থাকেন। হাসপাতালের এলাকাটি এত নীচু যে এক পশলা ভাল করে বৃষ্টি হলেই ওয়ার্ডে জল থইথই করে। জলে ভাসতে থাকে মলমূত্র। তার মধ্যেই থাকেন রোগীরা। সেখানেই পরিষেবা দিতে হয় ডাক্তার-নার্সদের। সে এক অবর্ণণীয় অবস্থা!’’ সুপার জানান, এ জন্যই এই হাসপাতালে রোগীরা আসতে চান না। তাতে বেলেঘাটা আইডি-র উপরে রোগীর চাপ বাড়ে। তিনি আরও জানিয়েছেন, গত বছর বর্ষায় ডাক্তারবাবুদের অবস্থা দেখে তিনি সুপারের ফান্ড থেকে প্রত্যেককে এক জোড়া করে গামবুট কিনে দিয়েছেন। যাতে সেটি পায়ে দিয়ে ডাক্তারবাবুরা ওই নোংরা জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে রোগী দেখতে পারেন। কিন্ত এ তো সমাধান হতে পারে না!
হাসপাতালের ৩ জন ডাক্তার ও ৮ জন নার্স স্বাস্থ্যঅধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন, যাতে অন্তত এ বার গ্রীষ্মের আগে ডায়েরিয়া রোগীদের বেডপ্যানের ব্যবস্থা হয়। কিন্তু যেখানে সরকারি হাসপাতালে ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রীর জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করছে সরকার, তখন সামান্য ক’টি বেডপ্যান কেনার কথা এতদিনে কারও মনে হল না?
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের যুক্তি, ‘‘স্বাস্থ্যভবনে বহুবার জানিয়েও লাভ হয়নি।’’ আর স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর উত্তর, ‘‘এই অবস্থার কথা জানা ছিল না। কেউ জানাননি। তবে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে ডায়েরিয়া রোগীদের জন্য যদি নিয়মিত বেডপ্যান ও গামলা পাঠানো হয়, তা হলে সত্যবালা আইডি-তে তা পাঠানোর কথা কারও মনে হল না কেন? স্বাস্থ্য অধিকর্তার উত্তর এসেছে, ‘‘কী হয়নি, কেন হয়নি বলতে পারব না। এখন যাতে হয় সেই ব্যবস্থা করা হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy