কসবার চক্রবর্তীপাড়ায় একটি নির্মীয়মাণ বাড়ি। —নিজস্ব চিত্র।
বছর দেড়েক আগের ঘটনা। কসবার ১০৭ নম্বর ওয়ার্ডের নস্করহাট-দক্ষিণপাড়ায় জমি কেনার পরে পাঁচিল দেওয়ার কাজ শুরু করেছিলেন এক প্রোমোটার। পাঁচিলের ভিত তৈরির জন্য মাটি কাটা শুরু হতেই মজুরদের মারধর। তার পরে বোমাবাজি। প্রোমোটারকে শাসক দলের এক নেত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে শাসানি দিয়ে গিয়েছিল কয়েক জন যুবক। তার পরে এক সকালে ওই প্রোমোটার এলাকার সেই নেত্রীর কাছে যান। নিজের অফিসে বসে নেত্রী প্রোমোটারকে বলেছিলেন, ‘‘জমি আপনার। কিন্তু বাড়ি তৈরি করবে আমার ছেলেরা। আপনি শুধু গৃহপ্রবেশ করবেন। যদি রাজি থাকেন, তো কাজ শুরু হবে। না হলে জমি বিক্রি করে দিন। বাজারদর অনুযায়ী আমরা কিনে নেব।’’ ওই প্রোমোটার অবশ্য জমি বিক্রি করেননি।। পাঁচ কাঠা জমির উপরে ওই নেত্রীর ছেলেদেরই চারতলা ফ্ল্যাট তৈরির বরাত দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
ওই ওয়ার্ডে নস্করহাট-দক্ষিণপাড়া-চক্রবর্তীপাড়া এলাকায় ওই নেত্রীর নিজের দুই ছেলেই সিন্ডিকেটের চাঁই। সেখানে শুধু ইমারতি দ্রব্য সরবরাহ নয়, গোটা নির্মাণকাজই এখন দখলে চায় সিন্ডিকেট। শুধু প্রোমোটার নয়, সাধারণ মানুষও বাড়ি তৈরি করতে গেলে একই নিয়ম।
বছরখানেক আগের ঘটনা। চক্রবর্তীপাড়ায় নিজের জমিতে ভিতপুজো করছিলেন এক অধ্যাপক। পুরোহিত মন্ত্রপাঠ শুরু করেছেন। পাশে বসে ওই অধ্যাপক ও তাঁর স্ত্রী। আচমকা পরপর কয়েকটি বোমা ফাটার শব্দ। তার পরেই হাজির একদল যুবক। একই শাসানি— ‘পুজো শেষ হওয়ার পরেই দিদির কাছে গিয়ে দেখা করবেন।’ ওই অধ্যাপককেও সেই নেত্রী একই আদেশ দিয়েছিলেন— ‘বাড়ি করব আমরা। আপনি শুধু গৃহপ্রবেশ করবেন।’
আরও পড়ুন:রোগী নেই ৩ দিন, জানেই না মেডিক্যাল
এলাকার এক প্রোমোটারের কথায়, ‘‘এটা হলো বৈধ নির্মাণ জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া ঘটনা। এ ছাড়া, সরকারি খাস জমিতে পুরসভার অনুমোদন ছাড়াই চার থেকে ছ’তলা বাড়ি উঠে যাচ্ছে। তা বিক্রিও করে দেওয়া হচ্ছে।’’
কসবা থানার এক তদন্তকারী অফিসারের কথায়, ‘‘গোটা নির্মাণকাজই এখন সিন্ডিকেটের মূল লক্ষ্য। প্রতি মাসেই ১০-১৫টি এমন অভিযোগ থানায় জমা পড়ে। বড়জোর দু’টি থেকে তিনটি মামলা হয়। পরে সব ‘ম্যানেজ’ হয়ে যায়।’’
কসবার রাজডাঙা এলাকার বাসিন্দা এক প্রোমোটারের কথায়, ‘‘শুধু বাড়ি তৈরি নয়, ইলেকট্রিক্যাল ওয়ারিং থেকে পাম্পসেট— সবই বসিয়ে দেবে সিন্ডিকেট। প্রতি বর্গফুটে ১৭০০ থেকে ১৮০০ টাকা নির্মাণের খরচ হিসেবে গুনে দিতে হবে ওদের। যদি পুরসভার অনুমোদিত নকশা থাকে, তা হলে সেটা ওদের দিয়ে দিতে হবে। বাকিটা ওরা বুঝে নেবে।’’
তা হলে এতে আপত্তির কী আছে? সবই তো ওরা করে দিচ্ছে। মুচকি হেসে ওই প্রোমোটারের জবাব, ‘‘বাজারের যত নিকৃষ্ট মানের সরঞ্জাম রয়েছে, তা দিয়েই কাজ করে ওরা। এক বছর পর থেকেই বাড়ি মেরামত করতে করতে ফতুর হয়ে যাবেন। সিন্ডিকেটের তৈরি বাড়ির গুণমান এতটাই খারাপ যে, আমরা তো অধিকাংশ ফ্ল্যাট বিক্রিই করতে পারিনি। এখন কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছি।’’ ওই প্রোমোটার জানান, নিম্নমানের সরঞ্জাম দিয়ে সিন্ডিকেট যে নির্মাণকাজ করে, তার খরচ মোটামুটি বর্গফুটে আটশো টাকা।
ওই এলাকার একাধিক প্রোমোটার জানিয়েছেন, যাঁরা কাজ বন্ধ করেননি, তাঁদের সিন্ডিকেটের নির্দেশ অনুযায়ীই চলতে হচ্ছে। আর যাঁরা সিন্ডিকেটের শর্ত মানতে পারেননি, তাঁরা হাত গুটিয়ে বসে রয়েছেন। এ ছাড়া এখন আর কোনও পথ নেই।
১০৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সুশান্ত ঘোষ বলেন, ‘‘এলাকায় নির্মাণকাজের ক্ষেত্রে কোনও অভিযোগ পেলেই আমি খতিয়ে দেখি। পুরসভা ও পুলিশকে জানানো হয়। এখানকার পরিস্থিতি যদি এমনই হয়ে থাকে, তা হলে আমি আরও কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করব।’’ এক পুলিশকর্তার দাবি, নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত হয়। প্রয়োজনে গ্রেফতারও করা হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy