Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

চোখ ফুলল ছেলের, আক্রান্ত কান্তিও

ঘড়িতে তখন সওয়া দশটা। শহিদ স্মৃতি কলোনির ‘এ’ ব্লকে দলীয় অফিসে গালে হাত দিয়ে চেয়ারে বসেছিলেন কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। পা দু’টো তোলা ছিল অন্য এক চেয়ারে। ওই ঘরের মধ্যেই তখন প্রাথমিক চিকিৎসা চলছিল জনাকয়েক পার্টি কর্মী এবং সংবাদমাধ্যমের কয়েক জন প্রতিনিধির।

কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের ছেলে সাম্যর (সাদা শার্ট) দিকে তেড়ে যাচ্ছেন তৃণমূল কর্মী়রা। ছবি: দেবাশিস রায়।

কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের ছেলে সাম্যর (সাদা শার্ট) দিকে তেড়ে যাচ্ছেন তৃণমূল কর্মী়রা। ছবি: দেবাশিস রায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:০৭
Share: Save:

ঘড়িতে তখন সওয়া দশটা। শহিদ স্মৃতি কলোনির ‘এ’ ব্লকে দলীয় অফিসে গালে হাত দিয়ে চেয়ারে বসেছিলেন কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। পা দু’টো তোলা ছিল অন্য এক চেয়ারে। ওই ঘরের মধ্যেই তখন প্রাথমিক চিকিৎসা চলছিল জনাকয়েক পার্টি কর্মী এবং সংবাদমাধ্যমের কয়েক জন প্রতিনিধির। স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলের একটি বুথ কেন্দ্রে ‘ছাপ্পা’ ভোটের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে আক্রান্ত হন তাঁরা। কান্তিবাবুর ছেলে সাম্য গঙ্গোপাধ্যায়ের দু’চোখেই আঘাতের চিহ্ন। অসম্ভব ফুলে গিয়েছে চোখ দু’টো। নেতার পাশেই মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলেন ওই এলাকার সিপিএম প্রার্থী শিখা পুজারি। সাহস পাচ্ছেন না সেই বুথে ফের ঢুকতে। এক সময় কান্তিবাবু তাঁকে বলেন, ‘‘ঘাবড়াচ্ছ কেন। যাও বুথে। মার দিলে, মার খাবে।’’ প্রায় চাপে পড়েই পার্টি অফিস থেকে বুথের দিকে এগিয়ে যান শিখা।

ঘরে রীতিমতো থমথমে পরিবেশ। নিজের খাসতালুকে বসে বিরোধীদের মারধর, চোখরাঙানি সহ্য করতে হচ্ছে অঞ্চলের ডাকসাইটে নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়কে, এটা বোধহয় মেনে নিতে পারছিলেন না তাঁর অনুগামীরা। পার্টি অফিসের বাইরে তাঁদের বলতে শোনা যায়, ‘চলো সবাই মিলে প্রতিরোধ করি।’ ব্যস ওইটুকুই। সাহস করে কেউ আর এগোননি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসেন শিখা। বুথে ঢুকতে পারেননি। আতঙ্কে সেখানকার প্রায় সব সিপিএম কর্মী-সমর্থকই। শিখা-সহ অনেকেই দাঁড়িয়ে থাকেন পার্টি অফিসের বাইরে, গাছের নীচে।

কিন্তু কেন? সিপিএমের এক বুথ এজেন্টের কথায়, ‘‘কাল রাতে আমার বাড়িতে থান ইট ছুড়েছিল তৃণমূলের কর্মীরা। নানা ভয় দেখায়। সে সবের তোয়াক্কা করিনি। বুথের এজেন্ট হয়ে বসেছিলাম। বেলা ১০টা নাগাদ তৃণমূলের কিছু ছেলে বুথ থেকে বেরিয়ে যেতে বলল। দু’মিনিটের মধ্যে কথা না শুনলে ঠ্যাং ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিল।’’ প্রথমটায় প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি হচ্ছে দেখে বুথ থেকে বেরিয়ে আসেন ওই এজেন্ট। তাঁর বক্তব্য, ‘‘কোনও বড় নেতা আসেননি। কান্তিদা ছাড়া পাশে কেউ নেই। কোন সাহসে আর বুথে যাব বলুন তো!’’

এরই মধ্যে জনা চল্লিশেক বাম সমর্থক জানালেন, তাঁদের বুথে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এক অটোচালকও বললেন, ভোট দিতে গিয়েছিলেন। ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাঁকেও। বৈদ্যুতিন মাধ্যমের এক প্রতিনিধি তাঁর বিবৃতি নিতে চাইলে ওই এজেন্ট বলেন, ‘‘ওঁকে কেন বিপদে ফেলছেন? রাতেই তো ধরে মারবে।’’

শহিদ স্মৃতি কলোনি প্রাথমিক স্কুলে তিনটে বুথ। প্রায় সাড়ে ৫ হাজার ভোটার। ওই এজেন্ট জানান, তাঁর বুথে সাড়ে এগারোশো ভোটারের মধ্যে সাড়ে তিনশো ভোট পড়েছিল। তার পরেই চলে আসে তৃণমূলের লোকেরা। বার করে দেওয়া হয় তাঁদের। অল্পবয়সী একটি মেয়ে চেঁচিয়ে বলতে থাকে, ‘‘আমার দাদাকে ওরা মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে।’’

একরাশ ক্ষোভ। কিন্তু প্রতিবাদের সাহস নেই। তবে কেউ কেউ দাবি তোলেন, ফের ভোট করতে হবে শহিদ কলোনিতে। এ সবের মধ্যেই শিখা হতাশ হয়ে বলতে থাকেন, ‘‘ওঁদের হাতেই পুলিশ। প্রশাসন। কী আর করব!’’ ঘণ্টাখানেক পরে অনেকেই ফিরে যান। তালা বন্ধ করে দেওয়া হয় পার্টি অফিসও।

সকালে ভোটের শুরু থেকেই ১০৯ নম্বর ওয়ার্ডের নানা বুথ থেকে সিপিএম এজেন্টদের মারধর করে বার করে দেওয়ার অভিযোগ আসছিল। সকাল সাতটা নাগাদ ভরতসিংহ কলোনি এলাকার একটি বুথে আশু দে নামে এক এজেন্টের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। তাঁকে ইএম বাইপাস-সংলগ্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভোট চলাকালীন প্রায় ২১টি বুথ থেকে এজেন্টদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে সিপিএমের অভিযোগ। পাল্টা অভিযোগ ওঠে সিপিএমের বিরুদ্ধেও। রাজ্যের মন্ত্রী তথা তৃণমূল নেতা অরূপ বিশ্বাস বলেন, ‘‘শহিদ স্মৃতি কলোনিতে আমাদের দলের প্রার্থী অনন্যাকে বুথে ঢুকতে বাধা দেয় বিরোধীরা। তাঁকে ওই এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়।’’

১০৯ নম্বর ওয়ার্ডে শাসকদলের তাণ্ডব আন্দাজ করা গিয়েছিল কয়েক দিন আগে থেকেই। রাতে বাড়ি গিয়ে শাসানি দেওয়া শুরু হয়েছিল। শুক্রবার রাতে তা মাত্রা ছাড়িয়ে যায় বলে অভিযোগ তুলেছেন সিপিএমের স্থানীয় নেতৃত্ব। অভিযোগ ওঠে, ওই রাতে মুকুন্দপুরে রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনী স্কুলে স্থানীয় তৃণমূল নেতা পিনাকী দেবের নেতৃত্বে প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের উপর চড়াও হন তৃণমূল কর্মীরা। আক্রান্ত হয়েছেন কান্তিবাবুর ছেলে সাম্য ও দুই দেহরক্ষী। ওই ঘটনার পরই ১০৯ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএমের একাধিক কর্মীর বাড়িতে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠে স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে। রাতভর আক্রান্ত কর্মীদের বাড়ি বাড়ি যান কান্তিবাবু। তার পর এ দিন সকালে সিপিএম প্রার্থী শিখার নির্বাচনী এজেন্ট সাম্যর উপর ফের চড়াও হন তৃণমূল কর্মীরা। তাঁকে বুথে যেতে বাধা দেওয়া হয়।

এ দিকে, কান্তিবাবুর উপর তৃণমূলের হামলার ঘটনায় তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কান্তিবাবু পুলিশ অফিসার গঙ্গাধর ভট্টাচার্য খুন, কসবায় আনন্দমার্গীদের খুনের ঘটনার নায়ক। তিনি আবার কী অভিযোগ করছেন।’’

কান্তিবাবুর জবাব, ‘‘উনি এখন মন্ত্রী হয়েছেন। সঠিক খবর রাখেন না বলে মনে হয়। আমি পুলিশ অফিসার গঙ্গাধর ভট্টাচার্য খুনের মামলায় সাক্ষী ছিলাম। অভিযুক্ত নই। আর আনন্দমার্গী খুনের ঘটনায় তদন্ত হয়েছে। পুলিশ আদালতে চার্জশিট পেশ করেছে। পার্থবাবু একটু যদি খোঁজ নেন, ভাল হয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE