Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

মনোরোগীদের খাবারে টান

বছর তিরিশের স্বাস্থ্যবান যুবক মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন পাভলভে। মাস ছয়েক পরে ছেলে সুস্থ হলে বাবা নিতে আসেন। কিন্তু ছেলেকে দেখে চিনতেই পারছিলেন না বাবা। চোয়াল ভাঙা, হাড় জিরজিরে চেহারার সন্তানকে দেখে কেঁদে ফেললেন তিনি।

তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৭ ০১:৩৮
Share: Save:

বছর তিরিশের স্বাস্থ্যবান যুবক মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন পাভলভে। মাস ছয়েক পরে ছেলে সুস্থ হলে বাবা নিতে আসেন। কিন্তু ছেলেকে দেখে চিনতেই পারছিলেন না বাবা। চোয়াল ভাঙা, হাড় জিরজিরে চেহারার সন্তানকে দেখে কেঁদে ফেললেন তিনি। ছেলে জানালেন, পেট ভরে খেতে পেতেন না। আর হাসপাতালে যে খাবার দেওয়া হয়, সেটা মুখে তোলা যায় না।

ওই যুবক ব্যতিক্রম নন। পাভলভে রোগীদের খাবারের মান নিয়ে অভিযোগ উঠেছে বারবার। সরকারি এই মানসিক হাসপাতালে অধিকাংশ রোগীকেই ভর্তি করে চলে যান বাড়ির লোক। বহু ক্ষেত্রে সুস্থ হওয়ার পরেও বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় না। আর ফিরিয়ে নিয়ে গেলেও ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে হাসপাতাল ছাড়েন তাঁরা।

মোটা চালের ভাত, লাউ-কুমড়োর ঘ্যাঁট বা কপি-গাজর-পটলের চচ্চ়ড়ি। দু’বেলা এই মেনু। মাছ, মাংস কার্যত জোটে না। যদিও প্রতিদিন খাবারের জন্য রোগী পিছু বরাদ্দ ৭২ টাকা। কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, সপ্তাহে এক দিন মাংস ও এক বেলা ডিম বরাদ্দ। যদিও এই দাবি মানছেন না অধিকাংশ রোগী। অনেক সময়ে থালা-বাটিও জোটে না বলে তাঁদের অভিযোগ।

একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পাভলভ হাসপাতাল চত্বরেই একটি ক্যান্টিন চালায়। যে রোগীরা সুস্থ হয়ে ওঠার পরেও বাড়ি ফিরতে পারেন না, তাঁরা সেখানে কাজ করেন। দিনের শেষে তাঁরা দোকানের বাড়তি খাবার খেয়ে তবে ফেরেন। তেমনই এক রোগী বলেন, ‘‘হাসপাতালের খাবার মুখে দেওয়া যায় না। তাই বাইরেই যতটা পারি খেয়ে নিই।’’ অনেকেই হাসপাতাল থেকে শুধু ভাত নেন। ক্যান্টিনের তরকারি দিয়ে সেই ভাত খান। তাঁদেরই এক জনের কথায়, ‘‘আমাদের তবু একটা বিকল্প আছে। কিন্তু অনেকেই রোজ আধপেটা, অখাদ্য খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।’’

মানবাধিকার কর্মী রত্নাবলী রায় বলেন, ‘‘আড়াইশো জনের সংসারে যদি সাড়ে পাঁচশো জন থাকে, তাহলে যা হয় এখানেও তা হচ্ছে। যে টাকা বরাদ্দ সেটা আড়াইশো রোগীর জন্য। সেই টাকাতেই সকলের খাবারের বন্দোবস্ত করা হচ্ছে, তাই পুষ্টিকর খাবার জুটছে না কারও। গলদটা গোড়াতেই। শুধু হাসপাতাল নয়, পুরো ব্যবস্থাটাই এই সমস্যার জন্য দায়ী।’’

মনোরোগ চিকিৎসকদের মতে, যে ধরনের ওষুধ মানসিক রোগীদের দেওয়া হয়, সেগুলি যথেষ্টই কড়া। তাই ওষুধের পাশাপাশি পথ্যের দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের খাবারের পরিমাণ যেমন স্বাভাবিকের থেকে একটু বেশি হওয়া দরকার, তেমনই খাবারের গুণমানের দিকেও নজরদারি দরকার।

পাভলভ হাসপাতালের সুপার গণেশ প্রসাদ বলেন, ‘‘খাবার নিয়ে নানা সমস্যার কথা জানতে পেরে একটি ডায়েট কমিটি তৈরি করেছি। সেখানে চিকিৎসকদের পাশাপাশি রোগীদের প্রতিনিধিও রয়েছেন। এখন এই কমিটির সদস্যেরা নিয়মিত খাবারের পরিমাণ ও গুণমান পর্যবেক্ষণ করেন। আশা করা যায় কিছু দিনের মধ্যে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হবে।’’

স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, শুধু পাভলভ নয়, সমস্ত সরকারি মানসিক হাসপাতালের ছবিই এক রকম। দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করার পরে বাড়ির লোকজন আর খোঁজ খবর রাখেন না। সুস্থ হলেও তাঁরা হাসপাতালেই থেকে যেতে বাধ্য হন। তাই শয্যার চেয়ে বেশি রোগী আর কম খাবারের সমস্যা কম-বেশি সর্বত্রই রয়েছে। পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া যত দিন না শুরু হচ্ছে তত দিন সমস্যা মেটার নয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE