ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল
খুশি রাখতে হয় থানা, পুরসভা, এবং স্থানীয় নেতাদের। তা হলেই কোথাও কোনও অসুবিধা হয় না, সব কিছু চলে স্বাভাবিক ভাবে। টান পড়ে শুধু পথচারীদের চলার পথে।
অভিযোগ, খুশি রাখার এই ফর্মুলাতেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, এইট বি বাসস্ট্যান্ড, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড, টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশন সংলগ্ন ফুটপাথ, রানিকুঠি, বাঘা যতীন মোড়-সহ যাদবপুর-টালিগঞ্জ তল্লাটের বিভিন্ন রাস্তা এবং ফুটপাথের একাংশ দখল করে চলছে হকার-রাজ। বিনিময়ে পথচারীরা যাচ্ছেন চলমান যানবাহনের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে।
প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের লেক গার্ডেন্স মোড় থেকে যাদবপুর থানা পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারে গজিয়ে উঠেছে হোটেল থেকে বিছানার দোকান। স্থানীয় এক হোটেল ব্যবসায়ী সোজাসাপ্টা বলছেন, ‘‘পুলিশ থেকে নেতা, সকলকে খুশি রেখেই আমরা চলি। তাই আমাদের সরানো সহজ নয়।’’ সাউথ সিটি মলের আশপাশের রাস্তাতেও ফুটপাথ জুড়ে দোকান থাকায় ঠিক মতো হাঁটা যায় না বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন রাজা এসএসসি মল্লিক রোডের দু’ধারও হকারদেরই দখলে। হকারদের অস্থায়ী ছাউনিতে বিশ্বদ্যালয়ের দু’নম্বর গেট প্রায় ঢাকা পড়ার দশা। ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের পরে যাদবপুর এইট বি বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন রাম ঠাকুর সরণি (সেন্ট্রাল রোড) চওড়া করা হয়েছিল।
হকারদের সরিয়ে আনা হয়েছিল একটি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্ক সংলগ্ন ফুটপাথে। এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, চওড়া রাস্তার একাংশে আবার নতুন করে শুরু হয়েছে হকারদের দৌরাত্ম্য।
ওই তল্লাটের এক খেলনা বিক্রেতাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল— রাস্তা আটকে এ ভাবে দোকান, পুলিশ তুলে দিলে কী করবেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘‘পুলিশের সঙ্গে আমাদের কোনও শত্রুতা নেই। তাঁরা আমাদের কেন তুলে দেবে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে আমরাও পুলিশকে সাহায্য করি। তাই আমাদের কোনও ভয় নেই।’’
বাঘা যতীন মোড়েও দিনের ব্যস্ত সময়ে রাস্তার দু’ধার হকারদের দখলে চলে যায় বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের। পরিস্থতি এমনই যে, সকাল-সন্ধ্যায় বাজারের বাইরে রাস্তার উপরে গজিয়ে ওঠে আরও একটি বাজার। রানিকুঠির মোড়ের ফুটপাথ ও রাস্তার একাংশেও একই হাল। এলাকার এক পোশাক বিক্রেতা বলেন, ‘‘আমাদের কেউ সরাতে পারবে না। আমাদের পাশে নেতারা রয়েছেন। তাই সরে যাওয়ার দুশ্চিন্তা করি না।’’
টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশন লাগোয়া ফুটপাথ যেন ‘সব পেয়েছির দেশ’। হকারদের সৌজন্যে এখানে জীবনযাপনে প্রয়োজনীয় সব জিনিসই মেলে। শুধু ফুটপাথে পাশাপাশি হাঁটতে পারেন না দু’জন পথচারী। এখানকার এক খাবার বিক্রেতা বলেন, ‘‘পুরসভা জানে আমরা এখানে দোকান দিয়েছি। পুলিশও জানে। কেউ আমাদের কোনও দিন কিছু বলেনি। আর নেতারা তো আমাদের পাশেই আছেন। তাই আমাদের কোনও ভয় নেই।’’
যাদবপুর-টালিগঞ্জের অলিগলিতে কান পাতলে শোনা যায়, শহরের অন্যান্য এলাকার মতোই এখানেও রাস্তা দখলের সমস্যা বহু দিনের। এলাকার প্রবীণ বাসিন্দারা জানান, ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পরে এলাকার বেকার যুবকদের কর্ম সংস্থানের পরিকল্পনা থেকেই রাস্তার ধারে দোকান বসানোর সূত্রপাত। অভিযোগ, সেই ট্র্যাডিশনের কোনও পরিবর্তন হয়নি ২০১১ সালে রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পরেও। বাসিন্দাদের অভিযোগ, উল্টে রাস্তার ধার দখল করে দোকান দেওয়ার প্রবণতা আরও বেড়েছে। এই সমস্যা নিয়ে এলাকার বরো চেয়ারম্যান তথা শাসক দলের অন্যতম নেতা তপন দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘এ নিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন না। এই সব বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’’
এলাকার হকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, যাদবপুর-টালিগঞ্জের কোন রাস্তায় কত জন হকার বসেন, তার একটা হিসেব ওই এলাকার পুলিশ এবং পুরকর্তাদের কাছে রয়েছে। তবে সেই হিসেব নিয়ে উভয় পক্ষই কোনও রকম মন্তব্যে নারাজ। ঘটনাচক্রে এই এলাকারই এক জন কাউন্সিলর কলকাতা পুরসভার জঞ্জাল অপসারণ বিভাগের মেয়র পারিষদও। রাস্তা হকারমুক্ত করা পুরসভার এই বিভাগেরই দায়িত্ব।
তাঁর তল্লাটেই হকারদের রমরমা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ৯৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং মেয়র পারিষদ (জঞ্জাল অপসারণ) দেবব্রত মজুমদার বলেন, ‘‘হকার সমস্যা তো আছেই। কিন্তু বিষয়টির সঙ্গে বহু মানুষের রুটি-রুজির প্রশ্ন যুক্ত থাকায় আমরা সমস্যাটি মানবিক দিক থেকে বিচার করি। এখন সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অনুযায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে কোনও হকারকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া যায় না। তাই রাস্তায় হকারও থাকবে, পথচারীও চলতে পারবেন— এ রকম একটা ব্যবস্থা আমরা করে রেখেছি।’’
কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষ কর্তার যুক্তি, পুলিশ হকার উচ্ছেদ করতে পারে না। ওই দায়িত্ব পুরসভার। এ কাজে পুরসভা যদি পুলিশের সাহায্য চায় বা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়, তখন পুলিশ তার ভূমিকা পালন করে।
বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? প্রশ্নটা তাই থেকেই যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy