রাখেন মেয়র, মারে কে!
কলকাতা পুরসভায় বকেয়া সম্পত্তি করের অর্ধেক সুদ মকুবের ক্ষেত্রে এখন থেকে সব ক্ষমতা মেয়রের হাতে। তিনিই ঠিক করবেন, কে এই ছাড় পাওয়ার যোগ্য। মঙ্গলবার মেয়র পরিষদ এই ক্ষমতা আনুষ্ঠানিক ভাবে দিল শোভন চট্টোপাধ্যায়ের হাতে। যে ঘটনা দেখে বিরোধীদের অনেকেরই বক্তব্য, একে তো সুদে অর্ধেক ছাড় দিয়ে প্রচুর টাকা লোকসান করবে পুরসভা। সম্পত্তি কর বকেয়া রাখতে যাঁরা অভ্যস্ত, বকলমে তাঁদেরই পাশে দাঁড়াবে। অন্য দিকে, ছাড় দেওয়ার ক্ষমতা এক জনের কুক্ষিগত হওয়ায় দুর্নীতির আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। বিধানসভা ভোট আগামী বছর। তার আগে বকেয়ায় ছাড় দিয়ে গরিবের পাশে দাঁড়ানোর মতো জনমোহিনী ঘোষণার মধ্যে আসলে লুকিয়ে থাকছে পক্ষপাতিত্বের সুযোগ।
সঠিক সময়ে সম্পত্তি কর না দিলে ওই করের উপরে সুদ ও জরিমানা দিতে হয় মহানগরের সংশ্লিষ্ট নাগরিককে। জরিমানা মকুব করার ক্ষমতা আগে থেকেই ছিল মেয়র পরিষদের। বিধানসভায় বিল পাশ করে অর্ধেক সুদ মকুবের ক্ষমতা দেওয়া হয় মেয়র পরিষদকে। মঙ্গলবার মেয়র পরিষদ সেই দায়িত্বই পুরোপুরি তুলে দিল মেয়রের হাতে। এই ক্ষমতা হাতে এসে যাওয়ায় পুরসভা আখেরে কত কড়ি হারাতে পারে, তারও হিসেবনিকেশ করতে শুরু করেছেন অনেকে। দেখা যাচ্ছে, ২০১৪-১৫ আর্থিক বছরে সুদ ও জরিমানা মিলিয়ে মোট ৮৫০ কোটি টাকা হারাবে পুরসভা।
কী ভাবে? পুরসভার কর মূল্যায়ন দফতরের এক আধিকারিক জানান, ৫ বছর আগে তৃণমূল বোর্ড ক্ষমতায় আসার পরে মোট বকেয়া সম্পত্তি করের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ আর্থিক বছরে বকেয়া সম্পত্তি করের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জরিমানার পরিমাণ কম, ৩০০ কোটি টাকা। আর সুদ ১ হাজার ১০০ কোটি। নতুন নিয়মে সুদের ৫০ শতাংশ এবং জরিমানার ৯৯ শতাংশ মকুব করার কথা বলা হয়েছে। তা হলে মেয়র অনুমোদন দিলে ৮৫০ কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি হবে পুরসভার।
এতে কি যথাসময়ে সম্পত্তির কর দেওয়ার প্রবণতা মার খাবে না? মেয়রের কাছে এই প্রশ্নের কোনও জবাব ছিল না। নিয়মিত কর দেন এমন এক প্রবীণ নাগরিকের মন্তব্য, ‘‘এখন মনে হচ্ছে কর বাকি রাখলেই ভাল হতো। বকেয়া টাকাটা ব্যাঙ্কে থাকলে সুদটা অন্তত জমত।’’
কেন এমন নিয়ম করল পুরসভা? মেয়রের জবাব, ‘‘সময়ে কর না মেটাতে পেরে অনেকেই আমাদের কাছে আসতেন। সুদ, জরিমানা মকুবের আবেদন জানাতেন। কিছু করতে পারতাম না। এখন সুবিধা হল।’’ বিরোধীরা অবশ্য আরও বড় অভিযোগ তুলেছে। তাদের বক্তব্য, পুরসভার এই সিদ্ধান্ত বিধানসভা নির্বাচনের আগে এক শ্রেণির নাগরিককে ‘ঘুষ’ দেওয়ার সামিল। সিপিএম নেতা তথা কলকাতার প্রাক্তন মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের অভিযোগ, ‘‘মেয়র থেকে শুরু করে প্রভাবশালী তৃণমূল কাউন্সিলরদের কাছে বকেয়া করদাতাদের ভিড় বাড়বে। তাঁদের ‘ম্যানেজ’ করতে পারলেই কাজ হয়ে গেল!’’ এই সিদ্ধান্তে ‘টাকা’ দিয়ে সম্পত্তি করের সুদ ফাঁকি দেওয়ার কাজও সমান তালে চলবে বলে অভিযোগ বিকাশবাবুর। আর যাঁরা ব্যবসায়ী তাঁরা করের টাকা সময়ে না দিয়ে অন্যত্র খাটাবেন। পরে এক সময় সুদ ও জরিমানার ছাড়ও নেবেন। বিজেপির রাজ্য সম্পাদক রীতেশ তিওয়ারির কথায়, ‘‘আসন্ন বিধানসভা ভোট মাথায় রেখে কলকাতা পুরবোর্ডকে ব্যবহার করলেন মুখ্যমন্ত্রী। সব ক্ষেত্রে ঘুষ দেওয়ার প্রবৃত্তি প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে তৃণমূল।’’ পুরসভার এক সিপিএম কাউন্সিলরের মন্তব্য, ‘‘মেয়র কি বকেয়া করের সুদ ও জরিমানা এমনি এমনি মকুব করবেন? এর থেকে মোটা টাকা উপায়ের রাস্তা বের করে নিলেন মেয়র।’’ তাঁর কথায়, ভোটের আগে সেই টাকায় মোটা হবে তৃণমূলের দলীয় তহবিলও।
মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় অবশ্য এই সব সমালোচনায় কান দিচ্ছেন না। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আইন সংশোধন করে আমরা যা করলাম, হিম্মত থাকলে তিনি বিকাশবাবুও তা করতে পারতেন। আসলে কলকাতার সঙ্গে নিজের দলটাকেও তুলে দিয়েছেন তিনি। আমি তো শুধু সম্পত্তি করের ৫০ শতাংশ সুদ মকুব করব। আমরা মানুষের কাছে দায়বদ্ধ। বিরোধীদের কাছে নয়।’’
পুরসভার এক আমলার কথায়, ‘‘ওয়েভার স্কিমের এটা নতুন সংস্করণ। যা কলকাতা পুরসভার ১৯৮০ সালের আইনে ছিল না। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিধানসভায় পুরনো ওই আইন সংশোধন করেছে রাজ্য সরকার। এ দিন মেয়র পারিষদ বৈঠকে তা গৃহীত হল।’’ এত দিন ওয়েভার স্কিমের জন্য রাজ্যপালের অনুমতি নিতে হতো। বারবার অনুমতি দিতে গিয়ে শেষে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন রাজ্যপাল। এ বার সরাসরি মেয়রের হাতে চলে এলো সেই ক্ষমতা। তাই ছাড় দেওয়ার ক্ষেত্রে এ বার থেকে শেষ কথা বলবেন তিনিই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy