Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

শিক্ষকতায় লিঙ্গবৈষম্য কোনও সমাধান নাকি

ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্য বিভাগের শিক্ষক তাপস দেবনাথ বলছেন, ‘‘এই দাবি মেনে নিলে অনেকেই তো চাকরি হারাবেন!’’ ঘটনাচক্রে, কারমেল স্কুলের অভিযুক্ত শিক্ষক রবীন্দ্রভারতীরই প্রাক্তনী।’’

স্কুলের সামনে কারমেলের ছাত্রীরা। ফাইল চিত্র।

স্কুলের সামনে কারমেলের ছাত্রীরা। ফাইল চিত্র।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০১:৫২
Share: Save:

বাড়িতে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নাচ নিয়ে স্নাতক পড়তে ভর্তি হয়েছিলেন এক গ্রামের তরুণ। কিন্তু নাচ শিখিয়ে পেটের ভাত জোগানো যাবে কি না, তা নিয়ে ঘোরতর চিন্তায় পড়েছেন তিনি। কারণ, কারমেল প্রাইমারি স্কুলে এক নাচের শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ ওঠার পরেই অভিভাবকদের একাংশের দাবি উঠেছে, মেয়েদের স্কুলে পুরুষ নৃত্যশিক্ষক রাখা যাবে না।

এ নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। কিন্তু কারমেলের বিক্ষোভ এবং এই দাবি ওঠার পরে কিছু বেসরকারি স্কুল যে সাবধানী পদক্ষেপ করছে, তার প্রমাণ পেয়েছেন আর এক যুবক। চাকরি পেয়েছিলেন একটি বেসরকারি স্কুলে। চলতি সপ্তাহেই যোগ দেওয়ার কথা ছিল নতুন চাকরিতে। কিন্তু তাঁকে মৌখিক ভাবে জানানো হয়েছে, এখন চাকরিতে যোগ দিতে হবে না।

এমন চলতে থাকলে নাচের শিক্ষক এবং পড়ুয়ারা কী করবেন? রবীন্দ্রভারতীর নৃত্য বিভাগের গবেষক সুগত দাস বলছেন, ‘‘ভিন্‌ রাজ্যের স্কুলে চাকরি করেছি, এ রাজ্যেও করেছি।কিন্তু এই দাবি শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছি।’’ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্য বিভাগের শিক্ষক তাপস দেবনাথ বলছেন, ‘‘এই দাবি মেনে নিলে অনেকেই তো চাকরি হারাবেন!’’ ঘটনাচক্রে, কারমেল স্কুলের অভিযুক্ত শিক্ষক রবীন্দ্রভারতীরই প্রাক্তনী।

শিক্ষা জগতের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই বলছেন, শুধু নাচ কেন, যোগব্যায়াম, ক্যারাটের মতো নানা বিষয় এখন অনেক স্কুলে শেখানো হয়। নাচের মতো সেগুলিতেও তো শিক্ষার্থীর গায়ে হাত ছোঁয়াতেই হয়। এর পরে তো ওই বিষয়েও পুরুষ শিক্ষকদের ব্রাত্য করে দেওয়ার দাবি উঠবে। অথচ এ রাজ্য এবং দেশের প্রথম সারির নৃত্যগুরুদের অনেকেই পুরুষ।

একটি বেসরকারি স্কুলের লাইব্রেরিয়ান পার্থপ্রতিম দাস। কিন্তু নাচের ডিগ্রি থাকায় স্কুলের ছাত্রীদের নাচও শেখাতে হয়। তিনি বলছেন, ‘‘একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যে ভাবে পুরুষ নৃত্যশিক্ষকদের গায়ে কালি ঢালা হচ্ছে, তা দুর্ভাগ্যজনক। মেয়েদের স্কুলে ছেলেরা নাচ শেখাতে পারবেন না, এই দাবি খুবই দুর্ভাগ্যজনক।’’ নাচের সঙ্গে যুক্ত পুরুষদের অনেকেই বলছেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বা গবেষণাগারে কি ছাত্রীরা যৌন হেনস্থার শিকার হন না? সেই সব জায়গা কি পুরুষশূন্য করে দেওয়া হয়েছে? একটি কো-এডুকেশন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের নৃত্যশিক্ষক সন্দীপ মল্লিক বলছেন, ‘‘কুপ্রবৃত্তি নারী-পুরুষ সকলের মধ্যেই থাকতে পারে। মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেরাও নাচ শিখতে আসছে। এমন চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ছেলেরা নাচ শিখতে বা শেখাতে আসবেন না।’’

অভিভাবকদের একাংশের এই দাবি নিয়ে রবীন্দ্রভারতীর নৃত্য বিভাগের গবেষক-ছাত্রী ইলিয়া দাসের মন্তব্য, ‘‘এই সব দাবি অবাস্তব। আগুপিছু না ভেবে শুধু কালি ছিটোনো হচ্ছে।’’ অনেকে এ-ও বলছেন, শিক্ষকের জায়গায় শিক্ষিকা রাখা হল। কিন্তু এখন তো ছেলেরাও নাচ শিখছে। ভবিষ্যতে কোনও কো-এড স্কুলে নৃত্যশিক্ষিকার বিরুদ্ধেও যৌননিগ্রহের অভিযোগ উঠবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়? হাওড়ার একটি ছেলেদের স্কুলের নৃত্য ও যোগশিক্ষিকা ইন্দ্রাণী দে মেনে নিচ্ছেন এ কথা। ‘‘পুরুষ শিক্ষকদের ব্রাত্য করার কোনও যৌক্তিকতা নেই। আমি নিজেই পুরুষদের কাছে নাচের অনেক কিছু শিখেছি,’’ বলছেন তিনি। এই কথার রেশ ধরেই নাচ নিয়ে গবেষণারত অহনা সরকারের প্রশ্ন, শিক্ষকতায় লিঙ্গবৈষম্য কোনও সমাধান না কি? এই ধরনের ঘটনা ঠেকাতে স্কুলগুলিতে যথাযথ পরিকাঠামো দরকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Student Teacher ছাত্র
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE