মিছিলের জেরে রুদ্ধ পথ। বুধবার ধর্মতলায়। — নিজস্ব চিত্র
পুজোর মুখে মিছিল-সমাবেশের হাতে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া শহরকে বাঁচানোর কোনও দাওয়াই নেই পুলিশ প্রশাসনের কাছে। উল্টে পুলিশেরই তরফে আগাম বার্তা দিয়ে বলে দেওয়া হচ্ছে, এমনই চলবে।
বুধবার একই দিনে তিন ধরনের মিছিল, সমাবেশ, দুর্ঘটনা এবং অবরোধে স্তব্ধ হয়ে যায় শহর। আর এ দিনই লালবাজার থেকে বলা হয়েছে, আজ, বৃহস্পতিবারেও মিছিলে জেরবার হতে হবে। এ দিন সকাল থেকে বামফ্রন্টের কৃষক সভার সমাবেশ রয়েছে রানি রাসমণি রোডে।
দুর্ঘটনা ও আচমকা অবরোধের উপরে কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু এক দিকে যখন পুজোর বাজারের ভিড়, অন্য দিকে বাঁশের ব্যারিকেডের জন্য সরু রাস্তার ঝক্কিতে এমনিতেই শ্লথ হয়ে গিয়েছে গাড়ির গতি, তখনই কেন একের পর এক মিছিল করার অনুমতি দিচ্ছে পুলিশ?
বুধবারের সকালে কাজে যাওয়ার পথে দীর্ঘ ক্ষণ আটকে থাকা অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, পুজোর মুখে শহরে কেনাকাটার জন্য বাইরে থেকে অতিরিক্ত মানুষ আসায় যে গাড়ির ভিড় বাড়ে, তা কি জানে না পুলিশ? মণ্ডপ তৈরি শুরু হওয়ায় বাঁশের ব্যারিকেডের জন্য সরু রাস্তায় যানজট যখন এমনিতেই বেড়ে যায়, তখন সব জেনে-বুঝেও কেন মিছিলের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে, উঠছে প্রশ্ন।
লালবাজারের এক কর্তার কথায়, ‘‘বুধবার আদিবাসী সংগঠনের যে সমাবেশটি ছিল, তা প্রতি বছর একই দিনে হয়। উদ্যোক্তাদের এ দিন ছিল প্রতিষ্ঠা দিবস। ভাবাবেগকে মাথায় রেখেই তাদের সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।’’ ওই কর্তার কথায়, ‘‘শহরে যান-যন্ত্রণার কথা ভেবে তৃতীয়ার দিন থেকে কোনও মিটিং-মিছিলের অনুমতি দেওয়া হবে না।’’
যার অর্থ, এই ভোগান্তি চলবে তৃতীয়া পর্যন্ত। যার আগাম বার্তা হিসেবে এ দিন বামফ্রন্টের কৃষক সভার সমাবেশের কথা জানিয়েছে পুলিশ। সেই কারণে, বৃহস্পতিবারেও বন্ধ রাখা হবে রানি রাসমণি রোড। অর্থাৎ, বুধবার এবং মঙ্গলবারের মতো আবার যানজটে নাকাল হওয়ার আশঙ্কা থাকছে। বৃহস্পতিবারের এই সমাবেশে যোগ দিতে এ দিনও হাওড়া, শিয়ালদহ ও অন্যান্য জায়গা থেকে মিছিল আসবে। তাতেও নাকানিচোবানি খাবেন মানুষ, পুজো বাজারে বেরোনো শহরবাসী।
বুধবার সকালটা শুরু হয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের মিছিল দিয়ে। পুলিশ জানিয়েছে, এ দিন সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত রানি রাসমণি রোডে আদিবাসীদের একটি সমাবেশ ছিল। তাতে যোগ দিতে হাওড়়া ও শিয়ালদহ স্টেশন থেকে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা মিছিল করে রানি রাসমণি রোডে আসতে শুরু করেন। হাওড়া স্টেশন থেকে প্রথম মিছিলটি বেরোয় সকাল ন’টা নাগাদ। অফিসটাইমে হাওড়া ব্রিজের উপরে লাইন দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে যায়। বাধ্য হয়ে অনেক অফিসযাত্রী হেঁটেই যান ডালহৌসি পর্যন্ত। হাওড়া স্টেশন থেকে ডালহৌসি পৌঁছতে যেখানে মেরেকেটে ১৫ মিনিট লাগার কথা, এ দিন সেখানে অন্তত ৪৫ মিনিট লেগেছে বলে জানান পথচারীরা।
শিয়ালদহ স্টেশন থেকে বেরোনো মিছিল ধর্মতলায় যাওয়ার জন্য এ জে সি বসু রোড, এপিসি রোড-সহ উত্তর কলকাতার বিস্তীর্ণ এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়। ধর্মতলার কাছে পুলিশের ক্ষণিকের ভুলে মিছিলের সামনে গাড়ি চলে আসায় সেই মিছিলকে মারমুখী হয়ে উঠতে দেখা যায়। পুলিশ জানায়, মিছিলে থাকা অনেকের হাতে বড় বড় কুঠার ছিল। তা দিয়ে তাঁরা গাড়ি ভাঙতে উদ্যত হন। ট্যাক্সিচালককে ধরে মারধরও করতে দেখা যায়। চুপ করে সেই দৃশ্য দেখা ছাড়া পুলিশকে আর কিছুই করেনি বলে অভিযোগ।
ওই সমাবেশের জন্য রানি রাসমণি রোড সকাল থেকেই বন্ধ করে দেওয়া হয়। অফিসটাইমে ওই গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাটি বন্ধ থাকায় জওহরলাল নেহরু রোড, এস এন ব্যানার্জি রোড, লেনিন সরণি, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউ, স্ট্র্যান্ড রোড, ব্রেবোর্ন রোডে তীব্র যানজট হয়। যার রেশ ছড়িয়ে পড়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে।
আদিবাসীদের এই সমাবেশের সঙ্গে যোগ হয় অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)-এর নেতৃত্বে প্রায় শ’তিনেক পড়ুয়ার মিছিল। এ দিনই দুপুরে শ্যামবাজার থেকে তাঁরা বিধান সরণি হয়ে কলেজ স্ট্রিটে পৌঁছন। শেষ মুহূর্তের পুজোর বাজার ঘিরে শ্যামবাজার, হাতিবাগান, কলেজ স্ট্রিট এখন এমনিতেই সরগরম। তার উপরে এ দিন বিধান সরণি দিয়ে মিছিল বেরোনোয় গাড়ি চলাচল বেশ কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়।
ফুটপাথবাসীদের নিরাপত্তা ও নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে এ দিনই বিকেল চারটে নাগাদ এপিডিআর-এর নেতৃত্বে বি বা দী বাগের টি বোর্ড থেকে একটি মিছিল বেরোয়। পুলিশের দাবি, প্রায় দেড়শো লোকের ওই মিছিল চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, বৌবাজার, ওয়েলিংটন হয়ে ধর্মতলায় পৌঁছয়। মিছিলের জন্য ওই সমস্ত রাস্তাতেও গাড়ি দাঁড়িয়ে যায়।
এখানেও শেষ হয়নি শহরবাসীর দুর্ভোগ। গড়িয়াহাটে স্থানীয় একটি স্কুলের কয়েকশো অভিভাবক রাস্তা অবরোধ করেন। অভিভাবকেরা জানান, আইসিএসসি অনুমোদন বাতিল হয়ে যাওয়ার পরে বিদ্যালয়টি মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অনুমোদন চেয়েছে। এ বিষয়ে তাঁদের জানানো হয়নি। এর ফলে তাঁদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। এ দিন দুপুর ২-৩০ মিনিট নাগাদ অবরোধ শুরু করেন। চলে প্রায় ৩-১৫ মিনিট পর্যন্ত। এর জেরে গড়িয়াহাট, রাসবিহারী, বালিগঞ্জ-সহ আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়।
এ দিন যানজটের হাত থেকে বাদ যায়নি মা উড়ালপুলও। বুধবার বেলা ১১টা নাগাদ মা উড়ালপুলের পার্ক সার্কাসগামী রাস্তার দিকে দু’টি গাড়ি পাশাপাশি ধাক্কা লাগায় একটি গাড়ি বিকল হয়ে পড়ে। প্রায় কুড়ি মিনিট গাড়িটি পড়ে থাকায় ব্যাপক যানজটের হয়। সাধারণত ওই উড়ালপুল ধরে সায়েন্স সিটি থেকে পার্কসার্কাস পৌঁছতে মেরেকেটে ৫ মিনিট লাগে, এ দিন সময় লেগেছে প্রায় আধ ঘণ্টা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy