Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

মাস পয়লায় টাকা তুলতে নাভিশ্বাস শহরের

মাসের প্রথম দিনটা কেটে গেল ব্যাঙ্ক আর এটিএমের মধ্যে দৌড়োদৌড়িতেই! বৌবাজার এলাকার এক কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসার দীপঙ্কর সরকার বুধবারই অফিসে বলে এসেছিলেন, বৃহস্পতিবার যেতে দেরি হবে।

টাকা তোলার অপেক্ষায়। বৃহস্পতিবার, বৌবাজারের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সামনে। — নিজস্ব চিত্র

টাকা তোলার অপেক্ষায়। বৃহস্পতিবার, বৌবাজারের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সামনে। — নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৬ ০১:২৬
Share: Save:

মাসের প্রথম দিনটা কেটে গেল ব্যাঙ্ক আর এটিএমের মধ্যে দৌড়োদৌড়িতেই!

বৌবাজার এলাকার এক কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসার দীপঙ্কর সরকার বুধবারই অফিসে বলে এসেছিলেন, বৃহস্পতিবার যেতে দেরি হবে। সকাল ন’টায় বিবাদী বাগের এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সামনে লাইন দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কাউন্টারের কাছাকাছি যখন পৌঁছলেন, ততক্ষণে নোটিস ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, ‘টাকা নেই’।

এমন যে হতে পারে তা আন্দাজ করে স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ের ডেবিট কার্ড পকেটে করে নিয়ে এসেছিলেন দীপঙ্করবাবু। বললেন, ‘‘ব্যাঙ্কে কিছুই না থাকলে চারটি এটিএম থেকে অন্তত ১০ হাজার টাকা তো তুলতে পারব!’’ শেষ পর্যন্ত ওই চারটি ডেবিট কার্ডই মুখরক্ষা করল আমার।’’ মাসের প্রথম দিনেই অবশ্য হাজিরার জায়গায় লাল কালির দাগ পড়ে গেল।

কলকাতা পুলিশের কর্মী শৈলেন পাহা়ড়ির বাড়ি নন্দীগ্রামে। গ্রামের ব্যাঙ্কেই অ্যাকাউন্ট তাঁর। এ যাবৎকাল মাস পয়লায় কলকাতার শাখা বা এটিএম থেকে বেতনের টাকা তুলে বাড়িতে দিয়ে আসতেন। এ দিনও টাকা তুলতে এলগিন রো়ডের শাখায় গিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যাঙ্ক জানিয়ে দেয়, যে শাখায় অ্যাকাউন্ট সেই শাখা থেকেই টাকা তুলতে হবে। তিনি জানান, দিন কয়েক আগে নাতনি হয়েছে। পরিচিতদের কাছে কিছু ধারদেনাও রয়েছে। তাই বেতনের টাকা তুলতে চেয়ে ম্যানেজারকে অনুরোধ করেছিলেন। লাভ হয়নি। রবীন্দ্র সদন-এলগিন রোড চত্বরে এটিএমে ঘুরেও টাকা মেলেনি। ভরদুপুরে টাকার খোঁজে নবান্নে রওনা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কোথায় টাকা?

শৈলেনবাবুর সঙ্গেই লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন হাওড়ার এক কারখানার অ্যকাউন্ট্যান্ট বীরেশ্বর সামন্ত। কোনও এটিএমে টাকা না পেলেও নবান্নে পাবেনই, এমন আশা নিয়ে এসেছিলেন তিনি। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এটিএমে টাকা নেই। অন্যটার সামনে তাই দীর্ঘ লাইন। ‘‘নিজের টাকা তুলতে পারব না, এ কেমন দিন এল বলুন তো,’’ লাইনের সামনে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন ওই কারখানার কর্মী। বৃদ্ধ ডেবিট কার্ড নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। পেনশনের অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকেছে। ব্যাঙ্কের কর্মী তাঁকে শনিবার যেতে বলেছেন। কিন্তু যে করেই হোক আড়াই হাজার টাকা তাঁকে তুলতেই হবে। ‘‘আমার আর গিন্নির ওষুধটা কিনতে হবে যে!’’

বাইরের লোক লাইন দেওয়ায় বেজায় ক্ষুব্ধ নবান্নের কর্মীদের কেউ কেউ। তাঁদের অবশ্য এ দিন অফিস কামাই করতে হয়নি। হাজিরা খাতায় সই করে কেউ লাইনে দাঁড়িয়েছেন। কেউ বা লাইন রেখে সই করে এসেছেন। বেতন তুলতে গিয়ে নাকানিচোবানি খেয়েছেন রাজ্য প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র, খাস নবান্নের কর্মীরাও। দুপুরে নবান্নে থাকা একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এটিএমে পাঁচশো এবং একশোর নোট মিলছিল। সর্পিল আকারে লম্বা লাইন পড়েছিল কাউন্টারের সামনে। কিন্তু হঠাৎ বিগড়ে গেল মেশিন! পাশের আর এক়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এটিএমে টাকা ভরা চলছিল তখন। হুড়োহুড়ি করে লাইন প়ড়ল সেখানে। এক জন ভিতরে ঢুকেই মুখ ব্যাজার করে বেরিয়ে এলেন। বললেন, ‘‘সব দু’হাজারি নোট।’’ বিকল হওয়া মেশিন সারিয়ে তুললেও লাভের লাভ হয়নি। কয়েক মিনিটের মধ্যে টাকা শেষ।

বেলা একটা। বৌবাজারের বিভিন্ন অফিসে খবর রটে গেল, বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিট এবং চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের সংযোগস্থলের একটি এটিএমে দু’হাজারের সঙ্গে একশোর নোটও মিলছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে অন্তত ৮০ জনের লাইন সেখানে। লাইনে দাঁড়ানো এক যুবকের মন্তব্য, ‘‘অফিসের কাজ পরে করলেও হবে। টাকা না তুললে মুদির দোকান, রান্নার লোকের মাইনে দেব কী ভাবে?’’ ওয়াটারলু স্ট্রিটের যে ব্যাঙ্কের এটিএমে বছরভর লোকের দেখা মেলে না, এ দিন বিকেলে সেখানেও চল্লিশ জনের লাইন! আর রাত আটটাতেও দেখা গেল ভিড় এতটুকুও কমেনি। হোটেল কর্মী আবদুল খালেকের মুখে বিজয়ী হাসি। হাতে চারটি ৫০০ টাকা ও পাঁচটি ১০০ টাকার নোট।

কলকাতার এক ওসি-র স্ত্রী এ দিন চেক নিয়ে বাড়ির কাছে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে গিয়েছিলেন। কিন্তু টাকা না থাকায় ফিরে আসতে হয়েছে তাঁকেও। ওসি-র থানা এলাকাতেই অবশ্য ওই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের একাধিক শাখা রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘সব শাখার ম্যানেজারই আমায় চেনে। প্রভাব খাটিয়ে চেক ভাঙাতে পারতাম। কিন্তু সাতসকালে লাইনে দাঁড়ানো মুখগুলো দেখে আর ইচ্ছে হল না।’’ একই পরিস্থিতি কলকাতা পুলিশের আর এক কর্মীরও।

মহাকরণের অদূরে একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের শাখায় এ দিন লাইনে কুপন বিলি হয়েছে!

লাইনে দাঁড়ানো এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, বেলা পৌনে এগারোটায় দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। পৌনে বারোটায় ব্যাঙ্কের এক কর্মী এসে নম্বর লেখা কুপন ধরিয়ে দিয়ে যান। ওই কুপন বিলি শেষ হওয়ার পরে আর কাউকে টাকা দেওয়া হবে না। কারণ, টাকার ভাঁড়ার যে বাড়ন্ত!

গ্রাহকদের পাশাপাশি ব্যাঙ্ককর্মীদের নিজেদেরও কিন্তু ভোগান্তি কম হয়নি এ দিন। এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার এ দিন সন্ধ্যায় বলেন, ‘‘ব্যাঙ্কের চেস্টে টাকা ফুরিয়েছে বেলা একটার মধ্যেই। আমিও নিজের বেতনের টাকা তুলতে পারিনি। টাকা তুলতে পারেননি আমার ব্রাঞ্চের কোনও কর্মীই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

ATM Moneyless Public Trouble
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE