Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সর্বস্ব দিয়ে হাসপাতাল গড়লেন বৃদ্ধ

অনেকেই বারণ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘শেষ বয়সে নিজের যাবতীয় সঞ্চয় দিয়ে দিলে চূড়ান্ত হেনস্থা ভোগ করতে হতে পারে।’’ তার উপরে অসুস্থ শরীর। প্রায় শয্যাশায়ী। ডায়ালিসিস করতে হয় প্রতি সপ্তাহে। চিকিৎসার খরচ রয়েছে। কিন্তু সাতষট্টি বছরের অবসরপ্রাপ্ত মাস্টারমশাইকে কোনও কিছুই দমাতে পারেনি।

অমিতানন্দ মৈত্র

অমিতানন্দ মৈত্র

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৭ ০১:৪৫
Share: Save:

অনেকেই বারণ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘শেষ বয়সে নিজের যাবতীয় সঞ্চয় দিয়ে দিলে চূড়ান্ত হেনস্থা ভোগ করতে হতে পারে।’’ তার উপরে অসুস্থ শরীর। প্রায় শয্যাশায়ী। ডায়ালিসিস করতে হয় প্রতি সপ্তাহে। চিকিৎসার খরচ রয়েছে। কিন্তু সাতষট্টি বছরের অবসরপ্রাপ্ত মাস্টারমশাইকে কোনও কিছুই দমাতে পারেনি।

জমানো টাকাপয়সার সবটুকু দিয়ে হাওড়ার বেলেপোলে ডুমুরজলা স্টেডিয়ামের কাছে আউটডোর এবং ১৫ শয্যার ইন্ডোরযুক্ত হাসপাতাল তৈরি করেছেন বর্ষীয়ান অমিতানন্দ মৈত্র। পয়লা বৈশাখ থেকে হাসপাতাল চালু হয়ে গিয়েছে। আপাতত মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি ও ইউরোলজি বিভাগ খোলা হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যে চালু হবে আইসিইউ। দর্শন ও বাংলার মাস্টারমশাইয়ের এই হাসপাতালে ৪০ শতাংশ রোগীকে ন্যূনতম টাকায় চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।

হাসপাতাল চালিয়ে, কর্মীদের বেতন দিয়ে তার পরে প্রায় অর্ধেক রোগীকে নামমাত্র টাকায় পরিষেবা দেওয়াটা সহজ নয়। তার উপরে অমিতানন্দবাবু ব্যবসায়ী নন। নিতান্ত মধ্যবিত্ত। কী ভাবে সামলাবেন এই বিপুল খরচ?

হাওড়ার ড্রেনেজ ক্যানাল রোডে অমিতানন্দ মাস্টারমশাইয়ের দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী অম্বিকা রায়চৌধুরী, পরমার্থ সেন, বীথিকা সিমলাইয়ের মতো প্রবীণরাই জানালেন, গত কয়েক বছর অশক্ত শরীরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাহায্য চেয়ে বেড়িয়েছেন। অনুরোধ করেছেন, যে যা পারেন, তা-ই যেন দান করেন হাসপাতালে। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী পরমার্থবাবুর কথায়, ‘‘আমরা বরং নিরুৎসাহিত করে বলেছিলাম, ‘নিজের সঞ্চয় এ ভাবে ব্যয় করার ভুল করবেন না।’ উনি কান দেননি। উল্টে বলতেন, ‘সাধারণ মধ্যবিত্তের উভয়সঙ্কট। তাঁদের এমন টাকা নেই যে, নামীদামি কর্পোরেট হাসপাতালে চিকিৎসা করাবেন। আবার সরকারি হাসপাতালে অপরিচ্ছন্নতা, অবহেলা মানসিক ভাবে মেনে নিতে পারেন না।’ এঁদের জন্যই কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন, এবং সেটা করে দেখালেন!’’

একা বৃদ্ধের লড়াই আর ইচ্ছাশক্তি দেখে একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও তাঁকে হাসপাতালের জন্য অর্থ তুলে দিয়েছেন। সরকারি ও বেসরকারি ১২ জন চিকিৎসককেও জোগাড় করেছেন তিনি, যাঁরা প্রায় নিখরচায় তাঁর হাসপাতালে পরিষেবা দিতে রাজি হয়েছেন। তাঁদেরই এক জন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিভাগের চিকিৎসক অর্ঘ্য মৈত্র বললেন, ‘‘এক জন সাতষট্টি বছরের বৃদ্ধ যদি নিজের সব কিছু দিয়ে একটা চেষ্টা করতে পারেন, তা হলে আমরা পাশে দাঁড়াতে পারব না?’’

কেদারনাথ ইনস্টিটিউশনের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অমিতানন্দবাবু অবশ্য বলেন, ‘‘পথটা দেখিয়ে গিয়েছিলেন আমার স্ত্রী সীমা। সংসার খরচের টাকা থেকে নিজেদের বাড়ির, আশপাশের বাড়ির কাজের লোক, দুধওয়ালি, ধোপা সবাইকে চিকিৎসার টাকা দিতেন। ২০১০-এ ওঁর মৃত্যুর পরে সেই ইচ্ছেটা আমার পেয়ে বসে।’’ হাসপাতালের নাম দিয়েছেন মৃতা স্ত্রীর নামে, ‘সীমা ইনস্টিটিউট অব হেল্থ কেয়ার।’ জানিয়েছেন, যাঁরা এখানে নামমাত্র টাকায় পরিষেবা পেতে চাইবেন, তাঁদের বার্ষিক আয়ের প্রমাণপত্র-সহ আবেদন করতে হবে। একটাই আশঙ্কা রয়েছে। যদি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কেউ জবরদস্তি অল্প খরচে চিকিৎসার সুযোগ আদায় করতে চায়, তা হলে কী হবে? স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক অরূপ রায় অবশ্য আশ্বাস দিয়েছেন, ‘‘মানুষের জন্য যে হাসপাতাল, সেখানে কেউ জুলুম করলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Old Man Hospital
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE