Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

যেতে পারি, কিন্তু মিটারে কেন যাব?

বার চারেক প্রত্যাখ্যাত হওযার পরে থামে একটি ট্যাক্সি। গন্তব্য পছন্দ না হওয়ায় আবার কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ান চালক। কিছুটা বিরক্ত হয়েই মহিলা বোঝাতে যান নিজের অসহায় পরিস্থিতি।

দাদা যাবেন? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উত্তর আসে, ‘না’। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ ঘুরে দেখা গেল এমনই চিত্র। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

দাদা যাবেন? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উত্তর আসে, ‘না’। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ ঘুরে দেখা গেল এমনই চিত্র। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

নীলোৎপল বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৮ ০৪:৩২
Share: Save:

মিটারে যাব না!

শহরের পথে ঘুরে বেড়ানো ট্যাক্সির নতুন হিসেব এমনই। যাত্রী অসুস্থই হোন বা অসহায়, পরোয়া নেই তাতে।

যেমন ঘটেছে দিন কয়েক আগে উল্টোডাঙায়। জ্বরে ছেলের গা পুড়ে যাচ্ছিল। ভরদুপুরে তার মাথায় তোয়ালে জড়িয়ে উল্টোডাঙার মোড়ে ট্যাক্সি দাঁড় করানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন মা। ডাক্তার দেখাতে যাবেন সল্টলেকের করুণাময়ীয়ে। কেও সোজা প্রত্যাখ্যান করছেন, কেউ বা ওইটুকু পথ যেতে হাঁক দেন আকাশ ছোঁয়া ভাড়া।

বার চারেক প্রত্যাখ্যাত হওযার পরে থামে একটি ট্যাক্সি। গন্তব্য পছন্দ না হওয়ায় আবার কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ান চালক। কিছুটা বিরক্ত হয়েই মহিলা বোঝাতে যান নিজের অসহায় পরিস্থিতি। চালকেরও সাফ জবাব, ‘‘অত তাড়া থাকলে ৩০০ টাকা দিন!’’

মিটার থাকে মিটারেরই মতো। এমন বহু ক্ষেত্রেই তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চান না ট্যাক্সিচালকেরা। চাঁদনি চক বা ধর্মতলা থেকে অফিস সেরে কসবা কিংবা বাইপাসের বাড়িতে ফিরতে ভর সন্ধ্যায় তাই নিত্য দিন নাজেহাল হতে হয় বহু যাত্রীকেই। যেমন বাইপাসের ধারের মুকুন্দপুর অঞ্চলের এক বাসিন্দার অভিযোগ, চাঁদনি চক থেকে তাঁর বাড়ি ফিরতে হাঁকা হয় ৪৫০ টাকাও। সল্টলেক চত্বরের আর এক যাত্রীর অভিযোগ, ভর দুপুরে সেক্টর ফাইভ থেকে শোভাবাজার যেতে চাওয়া হয়েছিল ২৫০ টাকা। বিরক্ত যাত্রী প্রশ্ন তুললে আসে সাফাই, ‘‘এখনও খাওয়া হয়নি। বেশি টাকা দিলে তবেই যাব।’’ যাত্রী পুলিশ ডাকার হুমকি দিলে ট্যাক্সিচালক ঝাঁঝিয়ে বলেন, ‘‘খেতে যাব। আমার সঙ্গে ভাতের হোটেলে চলুন। তার পরে দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছে দেব!’’

শহরের ট্যাক্সি ঘিরে যাত্রীদের বড় অংশের অভিজ্ঞতা এ রকমই। অফিস টাইমে বা রাত বাড়লে তো বটেই, অন্য সময়েও মনের মতো গন্তব্য না পেলে চালকদের নড়ানো যায় না। একাধিক আলোচনা, ট্যাক্সি সংগঠনগুলির শিক্ষামূলক কর্মসূচি এবং পুলিশি ‘তৎপরতা’-তেও তাদের ‘রিফিউজাল’ রোগ সারে না। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে মিম হয়, ‘প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হননি এমন মানুষ খুঁজলে পাওয়া যায়।
কিন্তু ট্যাক্সির প্রত্যাখ্যান জোটেনি, এমন মানুষ নেই’! রাসবিহারীর মোড়ে দাঁড়ানো এক ব্যক্তি বলেন, ‘‘বেশি রাতে বাড়তি ২০-৩০ টাকা যে দিতে হবে, তা ধরেই নিই। কিন্তু তাতেও সব সময়ে ট্যাক্সি পাওয়া যায় না।’’ শ্যামবাজারের মোড়ে ট্যাক্সির অপেক্ষারত আর এক যাত্রীর অভিজ্ঞতা, সামান্য দরাদরিতেই ট্যাক্সির চালকেরা বলে দেন, অ্যাপ-ক্যাব ডেকে নিতে। তেমনই এক চালকের যুক্তি, ‘‘হলুদ ট্যাক্সিতে মিটারে যে পথ যেতে ৬০ টাকা উঠবে, সেটায় ওরা তো ১২০ টাকা চায়। তখন তো দিতে গায়ে লাগে না!’’

কখনও অবশ্য ঘুরে দাঁড়ান যাত্রীরাও। যেমন উল্টো়ডাঙা থেকে চাঁদনি চক‌ যাবেন বলে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়েছিলেন এক যাত্রী।
চালক যেতে নারাজ। তাঁর যুক্তি ছিল, মিটার খারাপ। যাত্রীও নাছো়ড়।
চালক বলেন, ‘‘কত টাকা হতে পারে জানি। আর আপনি তো জানেনই। চলুন। দিয়ে দেব।’’ গাড়ি থেকে নামেননি যাত্রী। শত অনিচ্ছাতেও তাঁকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে হয়েছিল চালকের। তবে এমন ঘটনা এ শহরে বিরল। জোর চলে চালকদেরই।

‘জয়েন্ট কাউন্সিল অব লাক্সারি ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সুব্রতশঙ্কর ঘোষ অবশ্য সাধারণ ট্যাক্সির দায় নিতে নারাজ। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমরা যে সমস্ত পরিষেবা দিই, তা সাধারণ ট্যাক্সিতে কোথায়?
তা ছাড়া আমরা তো সরকারকে ভাড়া বেঁধে দিতে বলছি। যেতে না চাইলেও ওদের সংগঠন চালকদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করে না। তাই এ সব চলছে।’’ ট্যাক্সি সংগঠনগুলির অন্যতম ‘প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্সি ইউনিয়ন’-এর সাধারণ সম্পাদক শম্ভুনাথ দে-র অবশ্য বক্তব্য, ‘‘চালকদের দিকটাও ভাবতে হবে। ভাড়া বাড়ছে না, অথচ জ্বালানির দাম বাড়ছে। ফলে যে রাস্তায় গেলে লাভ হবে, সে দিকের যাত্রীদেরই তুলছেন চালকেরা। অ্যাপ-ক্যাবগুলি তো মনের মতো দাম নেয়।’’ চালকেরা সাফ বলে দেন, অন্য ট্যাক্সিতে তো ডাবল ভাড়া দিয়ে যান। তখন গায়ে লাগে না?

‘বেঙ্গল ট্যাক্সি ওনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’-এর যুগ্ম সম্পাদক সুমন গুহ অবশ্য জানালেন, ২০১২ সালে ভাড়া বেড়েছিল ট্যাক্সির। সেই নিয়মে গাড়িতে উঠলেই ন্যূনতম ২৫ টাকা ভাড়া দিতে হবে। এর দু’কিলোমিটার পর থেকে কিলোমিটার পিছু ভাড়া পড়বে ১২ টাকা। প্রতি ২ মিনিট ১২ সেকেন্ড ‘ওয়েটিং চার্জ’ দিতে হবে ২ টাকা ৪০ পয়সা। এর বাইরে গিয়ে বেশি ভাড়া চাইলে বা প্রত্যাখ্যান করলে তাঁদের ফোন
করে অভিযোগ জানাতে পারেন যাত্রীরা। তবে অভিযোগ করলেও মোটর ভেহিক্‌লসে শুনানির সময়ে কেউই যান না বলে তাঁর দাবি। তিনি বলেন, ‘‘অভিযোগকারীরাই হাল ছেড়ে দেন। তাই চালকদেরও নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।’’

অতএব, প্রত্যাখ্যানের ট্যাক্সি-যাত্রা চলছেই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

taxi refusal Taxi Fare dispute
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE