Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

দুপুর গড়ালে জায়গা জোটে না মুমূর্ষুরও

এক দল চিকিৎসকের প্রতিবাদে শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ দিনের অনিয়ম নিয়ে হুঁশ ফিরল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের।

এমনই হাল কিছু বিভাগের। মেডিক্যাল কলেজে। — নিজস্ব চিত্র

এমনই হাল কিছু বিভাগের। মেডিক্যাল কলেজে। — নিজস্ব চিত্র

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৬ ০১:৪৫
Share: Save:

এক দল চিকিৎসকের প্রতিবাদে শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ দিনের অনিয়ম নিয়ে হুঁশ ফিরল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের।

বছরের পর বছর মেডিক্যালের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের চিকিৎসকেরা বিকেল তিনটের পর থেকে ইমার্জেন্সি রোগী ভর্তি করেন না। যত অসুস্থ রোগীই আসুন না কেন, পত্রপাঠ তাঁদের রেফার করা হত। অবশেষে সেখানেরই কিছু চিকিৎসক এ ব্যাপারে ক্ষোভ জানানোর পরে কর্তৃপক্ষ স্বীকার করলেন, সরকারের নির্দেশ অমান্য করেই এটা চলছিল। কিছু বিভাগ গুরুতর অসুস্থ রোগীকে অন্য বিভাগে বা অন্য হাসপাতালে রেফার করে দায় সারছিল।

মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ নিজের মুখেই বলছেন, মেডিসিন বা সার্জারির মতো বিভাগ রোগীর চাপে হিমশিম খাচ্ছে। মেঝে ছাপিয়ে শৌচাগারের সামনে পর্যন্ত রোগীকে শোওয়াতে হচ্ছে। চিকিৎসকেরা ওয়ার্ডে হাঁটাচলা পর্যন্ত করতে পারছেন না। সেখানে কিছু বিভাগে প্রচুর ডাক্তার, পিজিটি, পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও তারা ‘মেঝেতে রোগী ভর্তি করা যাবে না’-এই কারণ দেখিয়ে ‘ইমার্জেন্সি অ্যাডমিশন’ অর্থাৎ গুরুতর অসুস্থদের জরুরি ভিত্তিতে ভর্তি নেওয়া বন্ধ রেখেছিল! এক দল ডাক্তারের প্রতিবাদের মুখে পড়ে এখন কর্তৃপক্ষ বলছেন, ‘‘ অন্যায় হচ্ছিল। এখন থেকে আর হবে না।’’

অভিযোগের তির সবচেয়ে বেশি চেস্ট বিভাগের দিকে। যক্ষ্মা, শ্বাসকষ্ট, বুকে জল জমার মতো বহু গুরুতর কেস সেখানে আসে। শয্যাসংখ্যা ৬০। চেস্টে ২২ জন পিজিটি, বহু সিনিয়র চিকিৎসক, নার্স, অন-কল চিকিৎসক থাকা সত্ত্বেও বিকেল তিনটের পরে সব ইমার্জেন্সি কেস মেডিসিন বিভাগে রেফার করে দেওয়া হচ্ছিল বছরের পর বছর। অভিযোগ, চেস্ট বিভাগের চিকিৎসকদের একাংশের চাপে শয্যাও বাড়ানো হয়নি। মাটিতে চিকিৎসা সম্ভব নয় জানিয়ে তাঁরা মেঝেতেও রোগী ভর্তি করতে চাননি। দুপুরের পরে যত অসুস্থ রোগী আসুন না কেন, রেফার করে দেওয়া হয় মেডিসিন বিভাগে। এ বার বেঁকে বসেছেন মেডিসিনের চিকিৎসকেরাও।

মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারি হাসপাতালে সমস্ত পরিষেবা ও ওষুধ ‘ফ্রি’ ঘোষণা করার পরে সব হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা গত কয়েক মাসে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। মেডিক্যালের ১৮০ শয্যার মেডিসিনে রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬০। মেঝেতে এত রোগী যে, চিকিৎসকেরা ইঞ্জেকশন-ড্রিপ চালানোর জায়গাও পাচ্ছেন না। শৌচাগারের সামনেও ভর্তি রোগী।

এতেই ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে মেডিসিনের কিছু ডাক্তারের। গত শুক্রবার তাঁরা সুপার শিখা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘরে গিয়ে প্রতিবাদ জানান। অভিযোগ, একই হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে রোগী ভর্তির বিভিন্ন নিয়ম থাকবে কেন? কেন একই লোকবল ও পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও কিছু বিভাগ চব্বিশ ঘণ্টা ইমার্জেন্সি রোগী ভর্তি করতে গিয়ে হিমশিম খাবে আর কেন কিছু বিভাগ বিকেল তিনটের পরে ইমার্জেন্সি রোগীর জন্য দরজা বন্ধ করে দেবে? কেন কিছু বিভাগের মেঝে ছাপিয়ে রোগী থাকবে আর কিছু বিভাগ মেঝেতে রোগী ভর্তি না করে রোগী ফিরিয়ে পার পেয়ে যাবে?

কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রতিবাদী চিকিৎসকদের আলোচনায় আরও তথ্য সামনে আসে। জানা যায়, চেস্ট বিভাগ ছাড়াও নিউরোসার্জারি, প্লাস্টিক সার্জারি, ইউরোসার্জারি, সাইকিয়াট্রি, গ্যাসট্রোএন্টেরোলজি, এন্ডোক্রিনোলজির মতো একাধিক বিভাগে শুধু আউটডোর থেকে রোগী ভর্তি করা হয়। ইমার্জেন্সি রোগী ভর্তি করা হয় না। আর ওই বিভাগগুলি থেকে রেফার করা রোগীর ভিড়ে হাঁসফাঁস করে মেডিসিন, গাইনোকোলজি বা সার্জারির মতো বিভাগ। মেডিসিন ও সার্জারির একাধিক জুনিয়র ডাক্তার জানিয়েছেন, তাঁদের বিভাগে হাঁটাচলা করতে গিয়ে যে কোনও সময়ে মেঝেতে শোয়া রোগীর দেহে পা পড়তে পারে।

এ ব্যাপারে চেস্ট বিভাগের প্রধান সুমিত্রা বসুঠাকুরের বক্তব্য, ‘‘আমরা মেঝেতে রোগী ভর্তি করার পক্ষপাতী ছিলাম না। এখন পরিস্থিতি অন্য রকম এবং সরকারও চাইছে রোগীরা যাতে প্রত্যাখ্যাত না হয়। তাই আমরা সরকারের নির্দেশই মানব। ইমার্জেন্সি রোগী ভর্তি ও মেঝেতে রোগী ভর্তি, দু’টোই এ বার হবে।’’

এত বড় সমস্যা যে তাঁদের চোখ এড়িয়ে ছিল, তা মেনে নিয়ে সুপার শিখা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘চেস্ট এবং কয়েকটি বিভাগে এই রকমই চলছিল। আগামী সাত দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো ও চিকিৎসকদের রোস্টার তৈরি করে ইমার্জেন্সি ভর্তি চালু করার নির্দেশ হয়েছে।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘সাইকিয়াট্রি, গ্যাসট্রোএন্টেরোলজি, এন্ডোক্রিনোলজির মতো অনেক বিভাগে শুধু আউটডোর থেকে রোগী ভর্তি হয় বলে অপেক্ষাকৃত কম গুরুতর রোগীও ভর্তি হন। তুলনায় মেডিসিন-সার্জারিতে গুরুতর অসুস্থ রোগী শয্যা পান না। তাই সাইকিয়াট্রি , চেস্ট বা এন্ডোক্রিনোলজির মতো বিভাগে নতুন কিছু শয্যা পাতা হচ্ছে। মেডিসিন ও সার্জারির গুরুতর অসুস্থদের সেখানে ভর্তি করা হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

emergency patients
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE