Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

এক্তিয়ার চুলোয় যাক, আগে নজর ‘দুর্নীতিতে’

বিবৃতি দিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা নিয়ে। অথচ তাতে শিক্ষক নিগ্রহ নিয়ে একটি শব্দও খরচ করলেন না শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। বরং গত ১ জুলাইয়ের ঘটনাকে ‘অনভিপ্রেত’ বলে তিনি মনে করিয়ে দিলেন, ‘‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুর্নীতির শিকড় উপড়ে ফেলাটাই বড় কথা। দুর্নীতি ও শিক্ষা একসঙ্গে চলতে পারে না।’’

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৫ ০৩:১২
Share: Save:

বিবৃতি দিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা নিয়ে। অথচ তাতে শিক্ষক নিগ্রহ নিয়ে একটি শব্দও খরচ করলেন না শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। বরং গত ১ জুলাইয়ের ঘটনাকে ‘অনভিপ্রেত’ বলে তিনি মনে করিয়ে দিলেন, ‘‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুর্নীতির শিকড় উপড়ে ফেলাটাই বড় কথা। দুর্নীতি ও শিক্ষা একসঙ্গে চলতে পারে না।’’

শিক্ষামন্ত্রীর এই মন্তব্য নিয়েই ফের প্রশ্ন উঠেছে এ দিন। অনেকেরই বক্তব্য, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ ঘিরে সাম্প্রতিক বিতর্কের সূত্রপাত ঠিকই। কিন্তু প্রথমত, দুর্নীতি যদি হয়েও থাকে, তার মোকাবিলা করবে বিশ্ববিদ্যালয়। তা নিয়ে রাজ্য সরকার মাথা ঘামাবে কেন? দ্বিতীয়ত, বিষয়টিকে আদৌ ‘দুর্নীতি’ বলা যায় কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে বিভিন্ন মহলে। বিষয়টি হাইকোর্টেও বিচারাধীন।

কাজেই শিক্ষামন্ত্রী যে ভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরাসরি ‘দুর্নীতি’ উপড়ে ফেলার ডাক দিয়েছেন, তাকে স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে সরকারি হস্তক্ষেপের লাগাতার চেষ্টা বলেই মনে করছেন অনেকে। অবশ্য শিক্ষামন্ত্রীই কিছু দিন আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনে নাক গলানো নিয়ে বলেছিলেন, ‘‘একশো বার নাক গলাব, মাইনেটা তো আমিই দিই!’’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে আন্দোলনরত শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীদের হেনস্থা করার ঘটনায় তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নাম জড়ালেও তাঁর প্রশ্ন ছিল, ‘দুর্নীতির দায়ে’ সাসপেন্ড হওয়া অফিসারের হয়ে কেন সওয়াল করছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা?

এ দিনও শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, কলকাতা-সহ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতি লক্ষ করা যাচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘এক দিকে রাজকোষে টাকা নেই। অন্য দিকে, সরকারের দেওয়া টাকা বাঁচিয়ে ফিক্সড ডিপোজিট করা হচ্ছে। যে টাকা ছাত্র-স্বার্থে লাগছে না, যা কলেজের স্বার্থে লাগছে না, যা সরকারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা, তা নিয়ে যদি অনিয়ম হয়ে থাকে, আমরা সে দিকে নজর দিচ্ছি। আর সেই নজর দেওয়ায় কেউ বাধা দিলে আমরা তার তোয়াক্কা করব না।’’

এখানেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-আধিকারিকদের যৌথ মঞ্চের বক্তব্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা কোথায় কী ভাবে খরচ হবে, তা ঠিক করার অধিকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেরই। সেখানে মন্ত্রী বা তাঁর দফতরের ভূমিকা কোথায়? বরং আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিনান্স অফিসারের সাসপেন্ড হওয়ার ঘটনায় উচ্চশিক্ষা দফতরেরই ‘ছক’ দেখছেন তাঁদের একাংশ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ কোটি টাকা খরচ না করে নিজের নামে স্থায়ী আমানত করে রাখার অভিযোগ উঠেছিল ওই ফিনান্স অফিসারের বিরুদ্ধে। সেই অভিযোগের তদন্তে নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি। তারা ওই আধিকারিকের বিরুদ্ধে রিপোর্ট দেয় এবং তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়। সেই সঙ্গে ফিনান্স অফিসার পদটিই আপাতত তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট। সূত্রের খবর, ওই পদ বিলোপের সুপারিশ এসেছিল শিক্ষা দফতর থেকেই। পরে অবশ্য মামলা হওয়ায় কলকাতা হাইকোর্ট ওই পদ বিলোপের সিদ্ধান্তে স্থগিতাদেশ দেয়।


সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

এ প্রসঙ্গে যৌথ মঞ্চের দাবি, ওই আধিকারিক পাঁচ কোটি টাকা নিজের নামে স্থায়ী আমানত করেছিলেন বলে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা ভিত্তিহীন। ব্যাঙ্কের তথ্যেই দেখা গিয়েছে, ওই আমানত রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে। তাদের বক্তব্য, একাধিক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে স্থায়ী আমানত হিসেবে রাখা আছে ৫৫৬ কোটি টাকা। মেয়াদ শেষে সুদ-আসল মিলে প্রায় ৭২৩ কোটি টাকা তো বিশ্ববিদ্যালয়েরই হাতে আসবে।

যদিও শিক্ষামন্ত্রীর যুক্তি, উন্নয়নের সরকারি টাকা খরচ না হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তা সরকারকেই ফিরিয়ে দেওয়া কথা। তিনি জানান, এর আগে কিছু অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল সিএজি। তার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যেও শিক্ষা দফতর দেখেছে, নির্দিষ্ট কিছু উন্নয়নের খাতে জমা পড়া টাকা খরচ করা হয়নি। ‘ফেলে রাখা হয়েছে’ ব্যাঙ্কে। উদাহরণ হিসাবে বলা হচ্ছে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট কিছু উন্নয়নমূলক কাজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট এক কোটি টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। অথচ তা থেকে শুধু কিছু কর্মচারীর জন্য খরচ করা হয়েছে এক লক্ষ টাকারও কম। এমনকী, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে কলেজ স্ট্রিট বা মহাত্মা গাঁধী রোডের অজস্র ব্যাঙ্ক ছেড়ে কেন বেলেঘাটায় একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখায় টাকা রাখতে যাওয়া হয়েছিল, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে শিক্ষা দফতর।

যৌথ মঞ্চের পাল্টা বক্তব্য, এর কোনওটাকেই ‘দুর্নীতি’ বলা যায় না। আর যদি দুর্নীতি হয়েও থাকে, সেটা বিশ্ববিদ্যালয় সামাল দেবে। সরকার নাক গলাবে কেন?

পক্ষান্তরে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য, তিনি ‘নাক গলাতে’ যাননি। কর্তৃপক্ষের পাশে দাঁড়িয়েছেন মাত্র। তাঁর কথায়, ‘‘আমি বলতে চেয়েছি, সরকার নানা ব্যাপারে আর্থিক অনুদান বা মদত দিয়ে থাকে। শিক্ষার নীতিও তৈরি হয় সরকারি স্তরেই। কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও বড় ঘটনা ঘটলে শিক্ষা দফতর কি চুপ করে বসে থাকবে? এর মধ্যে অন্যায় কোথায়?’’ পার্থবাবু এ-ও বলেন, ‘‘অভ্যন্তরীণ সমস্যা মেটানোর দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। তা নিয়ে কিছু বলার নেই। তবে আমার কাছে যদি তাঁরা সাহায্য চান, আমি নিশ্চয়ই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেব।’’ প্রশ্ন উঠেছে, দুর্নীতি-উচ্ছেদে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি পার্থবাবু বা তাঁর দফতরের সাহায্য চেয়েছেন?

শিক্ষা জগতের একাংশের আক্ষেপ, পার্থবাবু শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নৈরাজ্য বেড়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষক-হেনস্থায় প্রধান অভিযুক্ত শাসক দলেরই ছাত্র সংগঠনের মাথায় এখন শিক্ষামন্ত্রীরই অনুগত ছাত্রনেতা।

তৃণমূলেরই অনেকে মনে করেন, পার্থবাবুর দ্বৈত ভূমিকা শিক্ষাক্ষেত্রে পরিস্থিতি জটিল করছে। তৃণমূলের মহাসচিব হিসেবে তিনি ছাত্র বা কর্মচারীদের খুঁটিনাটি সম্পর্কে অবহিত।

তাঁদের কাজকর্ম পরিচালনাতেও হয়তো তাঁর ভূমিকা থাকে। কিন্তু যখনই দেখেন বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে, তখন শিক্ষামন্ত্রীর পদাধিকার বলে পরিস্থিতি সামাল দিতে আসরে নামেন। তাতে বিড়ম্বনা বাড়ে। যেমন হয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

হস্তক্ষেপের এই প্রক্রিয়ায় বিপদ দেখছেন বিশিষ্ট জনেরাও। মুম্বই হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়, কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি সমরেশ বন্দ্যোপাধায় ও অলক চক্রবর্তী, রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন সদস্য অমিত সেন এবং প্রেসিডেন্সি কলেজের সমাজবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন প্রধান প্রশান্ত রায় এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘ঐতিহ্যশালী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১ জুলাই যে ঘটনা ঘটছে, তা দুঃখজনক, অনভিপ্রেত ও নিন্দনীয়। আমরা এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারে হস্তক্ষেপ করা আদৌ বাঞ্ছনীয় নয়।’’

রাজ্য বিজেপির অভিযোগ, শিক্ষামন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দিচ্ছেন না। রাজ্য বিজেপির এক প্রতিনিধি দল এ দিন রাজ্যপাল তথা আচার্য কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর সঙ্গে দেখা করে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে। পাশাপাশি, হাইকোর্টের কোনও বিচারপতিকে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক অনিয়ম-সহ বিষয়টি তদন্ত করানোর আর্জিও জানান তাঁরা। এ দিনই আবার, একটি আলোচনাচক্রে যোগ দিতে গিয়ে রাজ্যপাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘উপাচার্য তাঁর মতামত জানিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক-ছাত্র উভয় পক্ষের এক সঙ্গে বসা উচিত। কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হল, শিক্ষাদান ও শিক্ষা গ্রহণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কাজকর্ম ফিরে আসা উচিত।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

abpnewsletters Partha Chatterjee teacher harassment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE