Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

শাসকের রং বদলায়, শুধু বদলায় না তপসিয়ার মুখ

বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা একই জায়গায়। সমবেদনা জানাতে দুর্ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে নেতা-মন্ত্রীদের স্রেফ ‘তদন্ত হবে’ মার্কা কথাবার্তা। ব্যস এটুকুই। একটি অগ্নিকাণ্ডের মাস কয়েক পরেই পরিস্থিতি আবার যে কে সে-ই! একের পর এক অগ্নিকাণ্ডেও তপসিয়ার ঘিঞ্জি এলাকায় দাহ্য পদার্থে বোঝাই বেআইনি কারখানাগুলির রমরমা কমে না। তপসিয়ার মতো একই হাল তিলজলা, ট্যাংরাতেও।

ঘিঞ্জি তপসিয়ায় সারিবদ্ধ অবৈধ কারখানা। মঙ্গলবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

ঘিঞ্জি তপসিয়ায় সারিবদ্ধ অবৈধ কারখানা। মঙ্গলবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

মেহবুব কাদের চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৫ ০৩:০৪
Share: Save:

বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা একই জায়গায়। সমবেদনা জানাতে দুর্ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে নেতা-মন্ত্রীদের স্রেফ ‘তদন্ত হবে’ মার্কা কথাবার্তা। ব্যস এটুকুই। একটি অগ্নিকাণ্ডের মাস কয়েক পরেই পরিস্থিতি আবার যে কে সে-ই! একের পর এক অগ্নিকাণ্ডেও তপসিয়ার ঘিঞ্জি এলাকায় দাহ্য পদার্থে বোঝাই বেআইনি কারখানাগুলির রমরমা কমে না। তপসিয়ার মতো একই হাল তিলজলা, ট্যাংরাতেও।

সোমবার ফের তপসিয়া রোডের দক্ষিণে একটি চামড়ার ব্যাগের কারখানায় আগুন লাগে। দমকলের ১৫টি ইঞ্জিন ঘটনাস্থলে পৌঁছনোর আগেই ওই কারখানা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এই ঘটনায় ফের বেআব্রু ওই অঞ্চলের পরিস্থিতি। পুরসভা সূত্রে খবর, যে বাড়িতে ওই কারখানা চলছিল, সেটি বেআইনি। ছিল না দমকলের অনুমোদনও। দমকল সূত্রে খবর, ওই কারখানাতেও অগ্নি-নির্বাপণের কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। পুরসভা সূত্রে খবর, তপসিয়া, তিলজলা, ট্যাংরায় প্রায় ১৫ হাজার এমন চামড়ার কারখানা রয়েছে, যার অধিকাংশই বেআইনি। বেআইনি নির্মাণ ভাঙতে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে পুরসভা? পুরসভা সূত্রের খবর, শহরের অন্যান্য এলাকায় বেআইনি নির্মাণ ভাঙলেও তপসিয়া-তিলজলায় নির্মাণ ভাঙতে সাহস পায় না পুরসভা।

২০০৬-এর নভেম্বরেও ভয়াবহ আগুন লাগে তপসিয়ায় একটি চামড়ার ব্যাগের কারখানায়। গভীর রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারান ১০ জন শ্রমিক। গুরুতর জখম ১৯ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। ঘটনার ন’বছর পরে মঙ্গলবার ৩৩সি তপসিয়া রোডের ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, চারতলা বাড়ির দোতলায় রমরমিয়ে চলছে চামড়ার ব্যাগ ও জুতো তৈরির কাজ। দোতলার ঘরের এক পাশে প্লাস্টিকের সরঞ্জাম। নীচ তলায় রয়েছে হোটেল, কাঠের আসবাবের দোকান। কলকাতা পুরসভার তথ্য অনুযায়ী, চারতলা বাড়িটির উপরের দু’টি তল বেআইনি। তিনতলার বাড়িতে আগুন লেগেছিল। নিয়ম অনুযায়ী, বাড়ির বেআইনি অংশ এত দিনে ভেঙে দেওয়ার কথা। কিন্তু এখনও তা ভাঙা হয়নি। পুরসভার ডিজি (বিল্ডিং ২) দেবাশিস চক্রবর্তীর সাফাই, ‘‘ওই বাড়ি আমরা দু’বার ভাঙতে গিয়েছিলাম। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দারা বাধা দেওয়ায় তা সম্ভব হয়নি।’’ তপসিয়ার অলিগলি ঘুরে দেখা গেল, অধিকাংশ ফ্ল্যাটের নীচের তলায় রয়েছে চামড়ার সামগ্রী তৈরির কারখানা। উপরের একাধিক তলায় ভাড়া থাকেন সাধারণ মানুষ। স্থানীয় বাসিন্দা মহম্মদ ইরফানের কথায়, ‘‘ফ্ল্যাটের মালিকেরা অতিরিক্ত মুনাফার আশায় নীচের তলায় চামড়ার ব্যাগ, জুতো বা প্লাস্টিক কারখানা হিসেবে ভাড়া দেন। ফ্ল্যাটের কোথাও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। তপসিয়ার অধিকাংশ বাড়ির মালিকেরা এলাকায় থাকেন না। ফলে যাবতীয় বিপদ পোহাতে হয় ফ্ল্যাটের বাসিন্দা ও কারখানার শ্রমিক কর্মচারীদের।’’

২০০৬ সালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী শেখ ইমতিয়াজ ৩৩সি তপসিয়া রোডের পাশের ফ্ল্যাটে একটি কারখানায় কর্মরত। ইমতিয়াজের কথায়, ‘‘ন’বছর আগের ভয়াবহ ওই আগুনের পরপর প্রশাসনের তরফে বলা হয়েছিল, তপসিয়ায় চামড়ার সামগ্রী তৈরির কারখানায় যুক্ত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য-বিমা চালু করা হবে। একই সঙ্গে যথাযথ দমকলের লাইসেন্স যাচাই করে এই ধরনের কারখানার অনুমতি দেওয়া হবে। কিন্তু ২০০৬ সালের পরে বারবার একই জায়গায় আগুনের ঘটনা ঘটলেও কলকাতা পুরসভা, পুলিশ, দমকল কেউই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে নারাজ।’’ এ প্রসঙ্গে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘‘এ বিষয়ে আমি কিছু মন্তব্য করব না।’’ দমকলমন্ত্রী জাভেদ খান তপসিয়া, তিলজলা এলাকায় অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার যে পরিকাঠামো নেই, তা স্বীকার করে নিয়ে বলেন, ‘‘তপসিয়া, তিলজলায় পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে। আমরা ধীরে ধীরে পরিকাঠামো উন্নয়নের চেষ্টা করছি। আমাদের সরকার জনমুখি সরকার। বেআইনি কারখানা বন্ধ করার বিপক্ষে আমরা। তবে আইনভঙ্গকারীদের শোধরাতে সময় দেওয়া হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফায়ার লাইসেন্সের অনুমতি না নিলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

অতীতে ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি ও ২০০৮-এর মার্চে ট্যাংরায় চামড়া কারখানায় ভয়াবহ আগুন লাগে। ২০০৪-এর ঘটনায় মারা যান দুই শ্রমিক। আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হন ছ’জন। ২০০৮-এ বিধ্বংসী আগুনে চামড়ার গুদাম পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ঘটনায় গুরুতর আহত পাঁচ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সোমবারের আগুন ফের প্রশ্ন তুলে দিল তপসিয়া অঞ্চলে অগ্নি-সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে। পুরসভার বিল্ডিং দফতরের আধকারিকেরা বলছেন, পুরসভা বেআইনি বাড়ি ভাঙতে গেলেও স্থানীয় বাসিন্দাদের বাধায় তা সম্ভব হচ্ছে না। দমকলের এক আধকারিকের কথায়, ‘‘তপসিয়া-তিলজলা-ট্যাংরায় অধিকাংশ চামড়ার কারখানাই হয় বেআইনি বাড়িতে, নয় তো সেগুলির দমকলের লাইসেন্স নেই।’’ দমকলের আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, তপসিয়া-তিলজলা-ট্যাংরা অগ্নিপ্রবণ এলাকা। এই সব এলাকায় সপ্তাহে গড়ে ৩-৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বেশির ভাগ ঘটনার খবরই পৌঁছয় না প্রশাসনের কাছে।’’ ওই আধিকারিকের সাফ কথা, “যথাযথ নজরদারি না হলে তপসিয়া সেই তিমিরেই থাকবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE