Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

অরণ্য বাঁচাও, বার্তা নিয়ে শহরে দম্পতি

দম্পতি ডাল-ভাতের বিনিময়ে বাঁদর ছানার প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলেন দলটির কাছে। সে বারের মতো কাজও হয়েছিল। এর পরেই বাঁদরটিকে নিয়ে মহারাষ্ট্রের এক অজ্ঞাত বন্য গ্রামে শুরু হয়েছিল পশুদের অনাথ আশ্রম।

প্রকাশ আমটে ও মন্দাকিনি আমটে। শুক্রবার, শহরে। —নিজস্ব চিত্র।

প্রকাশ আমটে ও মন্দাকিনি আমটে। শুক্রবার, শহরে। —নিজস্ব চিত্র।

সুচন্দ্রা ঘটক
শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭ ০১:৫৮
Share: Save:

মহারাষ্ট্রের এক জঙ্গল অঞ্চলে ঘুরতে ঘুরতে তাঁদের নজরে পড়েছিল, ছোট্ট একটি আহত বাঁদর ছানাকে নিয়ে যাচ্ছেন একদল মানুষ। নাগপুরের ওই চিকিৎসক দম্পতি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বাঁদরটির ভবিষ্যৎ কী? সে প্রশ্নে আরও অবাক দলটির তরফে উত্তর এসেছিল, ‘খাওয়া হবে!’

দম্পতি ডাল-ভাতের বিনিময়ে বাঁদর ছানার প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলেন দলটির কাছে। সে বারের মতো কাজও হয়েছিল। এর পরেই বাঁদরটিকে নিয়ে মহারাষ্ট্রের এক অজ্ঞাত বন্য গ্রামে শুরু হয়েছিল পশুদের অনাথ আশ্রম।

ঘটনাটি সত্তর দশকের। তখন সবে বিয়ে করেছেন আদ্যপ্রান্ত শহুরে ওই দুই চিকিৎসক প্রকাশ বাবা আমটে এবং মন্দাকিনি আমটে। ঘটনাটি মোড় ঘুরিয়ে দেয় তাঁদের জীবনের।

শুক্রবার কলকাতায় তৃতীয় আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণ ও পরিবেশ সংক্রান্ত চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনে এসে সে সব কথাই স্মরণ করলেন দম্পতি। সম্প্রতি তাঁদের জীবনী নিয়ে তৈরি হয়েছে ছবি। উৎসবে নানা পটেকর-সোনালি কুলকার্নি অভিনীত সেই ছবি প্রদর্শনের প্রাক্কালে আড্ডায় বসে আমটে দম্পতি বিস্ময় প্রকাশ করে জানান, এখনও বোঝেন না ছবির বিষয় হওয়ার মতো কী করলেন তাঁরা!

তবে কী আছে, তা বেরিয়ে আসে আড্ডার পরতে পরতে। গত ৪৪ বছর ধরে নাগপুর থেকে শ’তিনেক কিলোমিটার দূরে জঙ্গলের মাঝে এক আদিবাসী গ্রামে সংসার করছেন তাঁরা। সেখানে এক কালে বনের পশু শিকার করেই হত খাবারের জোগাড়। পশুদের বাঁচাতেই শুরু হয় আমটে দম্পতির কাজ। মন্দাকিনি বলেন, ‘‘এক কালে হেমলকাসা গ্রামে স্কুল-হাসপাতাল কিছুই ছিল না। জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে বাসিন্দারা জন্তু-জানোয়ার মেরে খেতেন। তাঁদের জীবনের মান খুবই অনুন্নত ছিল। আমরা প্রথমে ছোট্ট একটা চিকিৎসা কেন্দ্র করি সেখানে। যা সবচেয়ে ভাল পারি, তা দিয়েই পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলাম।’’

এখন তাঁদের আশ্রম দেশজুড়ে পরিচিত। কাজের স্বীকৃতি এসেছে নানা রূপে। পদ্মশ্রী দিয়ে প্রকাশকে সম্মানীত করেছে ভারত সরকার। তবে পথচলার শুরুটা সহজ ছিল না।

প্রকাশের মনে পড়ে, এক সময়ে স্থানীয় ওঝারা গ্রামের মানুষকে বাধা দিতেন তাঁদের কাছে চিকিৎসা করাতে গেলে। ধীরে ধীরে মন বদলায় গ্রামের লোকেদের। বছর দুয়েকের চেষ্টায় প্রকাশ-মন্দাকিনি হয়ে ওঠেন গ্রামের লোকেদের ভাউ-বইনি (দাদা-বৌদি)। প্রকাশ বলেন, ‘‘তারও এক বছর পরে ১৯৭৬ সালে শুরু হয় আসল কাজ। তৈরি হয় স্কুল। সঙ্গী হন আরও কয়েক জন স্বেচ্ছাসেবক।’’ শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতেই কেটে গিয়েছিল আরও কয়েকটা বছর। শেখানোর জন্য ইতিমধ্যে নিজেদের শিখতেও হয়েছে অঢেল। যার প্রথম পদক্ষেপ ছিল ভাষা শিক্ষা। স্থানীয়দের মাড়িয়া ভাষায় কথা বলতে পারতেন না শহুরে স্বেচ্ছাসেবীরা। চিকিৎসার কাজের ফাঁকে তাই ওই ভাষার অভিধান বানাতে থাকেন মন্দাকিনি।

শিক্ষার মাধ্যমেই মূল লক্ষের দিকে এগিয়ে যেতে পেরেছেন তাঁরা। সেই বাঁদর ছানার মতো একই ভাবে ভাতের বিনিময়ে বহু পশুর প্রাণ বাঁচাতে হত এক সময়ে। এক কালে পশুদের অথাথ আশ্রম, ‘অ্যানিমাল আর্ক’-এ ছিল প্রায় ৩০০ বন্যপ্রাণীর বসবাস। এখন পরিস্থিতি অনেক বদলেছে, জানালেন আমটে দম্পতি। তাঁদের আশ্রয়ে এখনও আছে প্রায় ১০০ প্রাণী। তবে মাড়িয়া জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই আর খাদ্যের জন্য শিকার করেন না। পড়াশোনা করে বদলে গিয়েছে তাঁর জীবনযাপনও।

তা হলে এখন কাজ কী আমটে দম্পতির? নিজেদের সন্তানেদের হাতে আশ্রমের গুরুদায়িত্ব দিয়ে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরছেন দম্পতি। বন্যপ্রাণ রক্ষার আর্জি নিয়ে যুব সমাজের কাছে পৌঁছতে চান তাঁরা। তাঁদের চিন্তা, অনেক ভাল কাজ আটকে থাকে ঠিক দিশা না পেয়ে। তরুণ সমাজকে দিশা দেখাতেই উৎসবের আয়োজকদের আমন্ত্রণে কলকাতা ঘুরে গেলেন তাঁরা। যে উৎসবের সৌজন্যে আগামী দু’দিন সচেতনতামূলক একগুচ্ছ ছবি দেখবে শহর। উৎসব অধিকর্তা আদিত্য মুখোপাধ্যায়ের আশা, ‘‘আমটে দম্পতিকে দেখে উৎসাহিত হবে এ শহরের তরুণ সমাজও।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE