Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

নীল-সাদা রং মাখলেই কি সুন্দর হয়! কর ছাড়ের জবাব চায় কোর্ট

ঘরবাড়িতে নীল-সাদা রং করলেই শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি হবে, এমন ভাবনার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলল হাইকোর্ট। প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর শুক্রবার সরকারি আইনজীবীর কাছে জানতে চান, “শহরের রাস্তাঘাটে আবর্জনা উড়ছে, প্লাস্টিক গড়াগড়ি খাচ্ছে। এই অবস্থায় নীল-সাদা রং করার উদ্দেশ্য কী?”

নিজস্ব সংবাদদাতা শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৫ ০৩:১৪
Share: Save:

ঘরবাড়িতে নীল-সাদা রং করলেই শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি হবে, এমন ভাবনার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলল হাইকোর্ট।

প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর শুক্রবার সরকারি আইনজীবীর কাছে জানতে চান, “শহরের রাস্তাঘাটে আবর্জনা উড়ছে, প্লাস্টিক গড়াগড়ি খাচ্ছে। এই অবস্থায় নীল-সাদা রং করার উদ্দেশ্য কী?”

শহরের ঘরবাড়িতে নীল-সাদা রং করলে কর ছাড় দেওয়ার পুর-সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছে হাইকোর্টে। এ দিন তার প্রথম শুনানিতেই প্রধান বিচারপতি চেল্লুর এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচির ডিভিশন বেঞ্চ এই প্রশ্ন তোলে। এত দিন বিরোধীদের অভিযোগ ছিল, পুরভোটের দিকে তাকিয়ে শহরবাসীর একাংশের মন পেতেই কর ছাড়ের টোপ ফেলেছে পুরসভা। ঘটনাচক্রে সেই পুরভোটের মুখেই হাইকোর্টে প্রশ্নের মুখে পড়ল সেই সিদ্ধান্ত। রাজ্য সরকার ও কলকাতা পুর কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়ে ডিভিশন বেঞ্চ বলেছে, কোন যুক্তিতে কর ছাড়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা চার সপ্তাহের মধ্যে হলফনামা দাখিল করে আদালতে জানাতে হবে।

আদালতের পর্যবেক্ষণ শুনে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “শহরের ঘরবাড়ি নীল-সাদা রং করা সৌন্দর্যায়নের জন্যই। এখন আদালত এই নিয়ে কিছু জানতে চাইলে আমরা তার ব্যাখ্যা দেব।”

গত বছরের ৮ জুন কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদের বৈঠকে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয় পুর এলাকার যে সব বাড়িতে নীল-সাদা রং করা হবে, তাদের এক বছরের জন্য সম্পত্তি করে ছাড় দেওয়া হবে। এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এ মাসের ১২ তারিখ কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থে মামলা দায়ের করেন পার্ক স্ট্রিটের বাসিন্দা জনৈক তনভির আহমেদ খান। তনভিরের আইনজীবী শ্রীজীব চক্রবর্তী আদালতে আবেদন করে বলেছেন, এ ভাবে কর ছাড় দেওয়া অসাংবিধানিক। ওই আবেদনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, কলকাতা পুরসভার কোনও আইনে এ রকম ভাবে করছাড় দেওয়ার সংস্থান আছে কি? এতে কি নাগরিকদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করা হচ্ছে না? যাঁরা বাড়িতে নীল-সাদা রং করাতে রাজি নন, তাঁরা পরে কোনও সমস্যায় পড়লে তার দায়িত্ব কে নেবে এ সবও তনভিরের প্রশ্ন।

এ দিন মামলাটি হাইকোর্টে শুনানির জন্য ওঠে। পুরসভার হয়ে মামলাটি লড়ছেন রাজ্যের অতিরিক্ত অ্যাডভোকেট জেনারেল লক্ষ্মী গুপ্ত। তিনি শুরুতেই বলেন, নীল-সাদা রং করার কথা বলা হয়েছে শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য। কর ছাড় দেওয়ার পুর-সিদ্ধান্তটি প্রস্তাব আকারে রাজ্য বিধানসভায় পাঠানো হয়েছিল। প্রস্তাবটি বিধানসভায় পাশ হয়ে যায়। কিন্তু আবেদনকারী বিধানসভার সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ না করে পুরসভার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। অতএব এই মামলা শুনানির জন্য গ্রহণযোগ্য নয় বলে আদালতে দাবি করেন তিনি।

সরকারি আইনজীবীর এই যুক্তি আদালত মানেনি। বিচারপতি জয়মাল্য বাগচি তাঁকে থামিয়ে বলেন, “যিনি মামলা করেছেন, তিনি পুরকর দেন। তাঁর মামলা করার অধিকার অবশ্যই রয়েছে।” এর পরেই প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর প্রশ্ন করেন, শহরের সৌন্দর্যায়ন মানে কি নীল-সাদা রং?

ক্ষমতায় এসেই কলকাতা শহরকে ‘লন্ডন’ বানানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে শহর যাতে সুন্দর দেখায়, তার জন্য তাঁর দাওয়াই ছিল নীল-সাদা রংয়ে শহরকে মুড়তে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছাপূরণে সরকারি ভবন থেকে রাস্তাঘাট, পথের মাঝের ডিভাইডার, ফুটপাথের রেলিং, গাছের গুঁড়ি মায় ট্যাক্সি পর্যন্ত নীল-সাদা রং নিয়েছে। রাজ্য প্রশাসনের সদর কার্যালয় নবান্নের গায়েও পড়েছে নীল-সাদা প্রলেপ। মুখ্যমন্ত্রীর মন রাখতে সরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে বিজ্ঞাপন, আমন্ত্রণপত্র সবই এখন নীল-সাদা। এই পথেই আর এক কদম এগিয়ে বসতবাড়িতে নীল-সাদা রং করলে কর ছাড় মিলবে বলে ঘোষণা করেছিল পুরসভা। পরে বিধানসভাও তাতে অনুমোদন দেয়।

এ দিন অতিরিক্ত অ্যাডভোকেট জেনারেলের কাছে বিচারপতি জয়মাল্য বাগচি জানতে চান, “কী উদ্দেশ্য নিয়ে পুরসভা এই ভাবে কর ছাড়ের সিদ্ধান্তে পৌঁছল?” তিনি মন্তব্য করেন, “শহরের ঐতিহ্যশালী ভবন বা সরকারি স্কুলকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট রং করা যেতে পারে। কিন্তু পুর কর্তৃপক্ষ যখন ঘোষণা করছেন বাড়িতে নীল-সাদা রং করলে কর ছাড়, তখন তা আর প্রস্তাব থাকে না, বাধ্যবাধ্যকতা হয়ে দাঁড়ায়।”

এর পরেই প্রধান বিচারপতি বলেন, “শুধু নীল-সাদা রং কেন! চাইলে অনেক ভাবেই শহরের সৌন্দর্যায়ন করা যায়।” কী ভাবে তা হতে পারে এবং সরকার কী ভাবে তাতে উৎসাহ দিতে পারে, তার উদাহরণও দেন তিনি। প্রধান বিচারপতি বলেন, “শহরে বাগান করে সৌন্দর্যায়ন হতে পারে। যাঁরা নির্দিষ্ট জায়গায় আবর্জনা ফেলবেন, বাগান করবেন, গাছ লাগাবেন অথবা বৃষ্টির জল ধরে রাখার ব্যবস্থা করবেন তাঁদের ক্ষেত্রে কর ছাড় দিলে তার একটা অর্থ রয়েছে। কিন্তু নীল-সাদা রং করে সৌন্দর্যায়নের যুক্তি কী? তার অর্থই বা কী?”

অতিরিক্ত অ্যাডভোকেট জেনারেল তখন প্রধান বিচারপতিকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চান, জয়পুর শহর ‘পিঙ্ক সিটি’ বলে পরিচিত। কলকাতার জন্য সে ভাবেই নীল-সাদা রং বাছা হয়েছে। শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন প্রধান বিচারপতি। লক্ষ্মীবাবুর উদ্দেশে তিনি বলেন, “জয়পুর শহরের ঐতিহ্য কয়েকশো বছরের পুরনো। সেখানকার গোলাপি মার্বেল পাথর তাকে ‘পিঙ্ক সিটি’ করে তুলেছে। কলকাতার ঐতিহ্য অন্য রকম। আপনি প্রমাণ করুন, আপনার শহর জয়পুরের মতো।” বিচারপতি জয়মাল্য বাগচি বলেন, “পুর কর্তৃপক্ষ যদি মনে করেন, আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দেবেন, তা হলে সেটা প্রত্যেক নাগরিককে দিন। এই ধরনের সুযোগ এক জনকে দেওয়া হলে অন্যের কাছে তা বোঝার সামিল। নির্দিষ্ট রং করলে তবেই আর্থিক সুযোগ, এর পিছনে কী যুক্তি আছে?”

এই বিতর্কে হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণে বিরোধীরা খুশি। সিপিএম নেতা রবীন দেব প্রধান বিচারপতির মন্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, “বেসরকারি বাড়িতে নীল-সাদা রং করলে কর ছাড় পাওয়া যাবে, অন্যদের কর বাড়বে। এমন সিদ্ধান্ত দেশে নজিরবিহীন, অভূতপূর্ব।” তবে বিচারপতিদের বক্তব্য রাজ্যের কানে ঢুকবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান রবীনবাবু। বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের কটাক্ষ, “আমার মনে হয় মহামান্য আদালতের উচিত নবান্নে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করা। একটার পর একটা ঘটনায় রাজ্য আদালতে তিরস্কৃত হচ্ছে।” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া, “মুখ্যমন্ত্রীর পছন্দ জনতা মানলে তিনি উৎকোচ দেবেন, এমন ব্যক্তিপূজা গণতন্ত্রে হয় না কি?” কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানও আদালতের বক্তব্যকে স্বাগত জানান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE