উৎসব-খুশি-প্রীতি-আনন্দের মিশেল নিয়ে আমাদের আটপৌরে দিন-আনা দিন-গুজরান নিয়ে ‘পুজো আসছে’। পুজো মানেই নতুন জামা, নতুন শাড়ি, নতুন জুতো, ম্যাচিং ঝুটো গহনা কিংবা শারদ সংখ্যার নতুন বইয়ের গন্ধ। কম বয়সে নতুন জামা-জুতোর একটা টান তো ছিলই, সবারই থাকে। কিন্তু ‘পুজো আসছে’ এই সময়টায় দারুণ উত্তেজনায় থাকতাম। নিউজ প্রিন্টে ছাপা পুজোসংখ্যা হাতে পাওয়ার জন্য। সে যেন এক কথাসরিৎসাগর। বাবা কবে কিনে এনে দেবে ‘দেব সাহিত্য কুটিরে’র বোর্ডবাঁধাই রঙিন প্রচ্ছদের পুজোসংখ্যা, অথবা যিনি রোজ বাড়িতে কাগজ দেন, সেই হকারকাকু কবে সদরদরজার দোরগোড়ায় রেখে যাবেন কিশোরপাঠ্য শুকতারা, আনন্দমেলা, কিশোরভারতী। কিশোরীবেলায় হাতে পাওয়া মাত্রই নাওয়াখাওয়া ভুলে পড়ে ফেলতাম এক্কেবারে প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা।
আজকাল বহু পুজোবার্ষিকী প্রকাশিত হয় রথ-এর সময় থেকে শুরু করে মহালয়ার আগে পর্যন্ত। প্রাতিষ্ঠানিক হাউসের নামী পুজোবার্ষিকীগুলো পাঠকের কাছে একে একে আসতে থাকে ‘রথ’-এর সময় থেকেই। মহালয়ার শুভ দিনে বা পঞ্চমী-ষষ্ঠীর সকাল-বিকেলেও প্রচুর সাময়িকী পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়। পুজোর মাস থেকেই যাবতীয় লিটল ম্যাগাজিন তাদের শারদ সংখ্যা একে একে প্রকাশ করতে থাকে। ব্যক্তিগত ভাবে বলি, নিজেও যেহেতু বেশ কিছু নামীদামি পত্রপত্রিকায় ও নামকরা কিছু লিটল ম্যাগাজিনের শারদ সংখ্যায় এবারও লিখেছি, তাই সুদূর মুম্বইয়ে সেগুলি হাতে পাওয়ার জন্য প্রতীক্ষায় থাকি। কোনও সম্পাদক স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে শেই শারদসংখ্যা ডাক বা কুরিয়র মারফত পাঠিয়েও দেন। লিখলেও বেশির ভাগ শারদসংখ্যা হাতে পাই না। সম্পাদক মুম্বই পাঠানোর ব্যয়ভার বহন করতে রাজি থাকেন না। তবু শারদসম্ভার ও দৈনিক পত্রপত্রিকার বিশেষ ক্রোড়পত্র পড়ার আগ্রহ থাকেই সবার।
শারদীয়ার আরও একটা বড় আকর্ষণ ছিল পুজোর গান। এক সময় বাড়িতে বেতার জগৎ পত্রিকা আসত। ওই পত্রিকা ও অন্যান্য জায়গায় আগামী পুজোর গানের লিস্ট বের হতো। সেখানে ছবি-সহ গায়ক-গায়িকা-গীতিকার-সুরকারের নামও দেওয়া থাকত। এক এক শিল্পীর ডজনখানেক করে গান। নতুন জামাকাপড়, জুতোর সঙ্গে নিজেদের পছন্দমতো পুজোর গানের ক্যাসেটও কেনার চল ছিল তখন। আর মহালয়ার আগে আগমনি এবং শাশ্বত মহিষাসুরমর্দিনীর ক্যাসেটও কেনা ছিল অবশ্যম্ভাবী ব্যাপার।
সদ্য মুম্বই ফিরেছি কলকাতায় দেড়খানা মাস কাটিয়ে। কলকাতার নতুন হুজুগ খুঁটিপুজো। পুজোর মাসতিনেক আগে থেকেই কোনও এক শুভদিন দেখে পুজোর পরিকল্পিত স্থানে খুঁটি পুঁতে পুজোআচ্চা করার ধুম এখন কলকাতায়। খুঁটিপুজোর পর থেকেই তিন মাস ধরে থিম-পুজোর পরিশ্রম। পুজোর থিম সং তৈরি, টলিউডের নামকরা কোনও মিউজিক ডিরেক্টরকে দিয়ে, মণ্ডপের আবহের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে থিম সঙের প্রস্তুতি। কলকাতার সব বারোয়ারি পুজোর ম্যারাপ বাঁধা এখন প্রায় শেষের মুখে। বৃষ্টিবাদল সামলে প্রতিমা তৈরির কাজ চলছে। রাস্তা জুড়ে বড় বড় ফ্লেক্স আর হোর্ডিং-এ চোখধাঁধানো বিজ্ঞাপন। কলকাতার গড়িয়াহাট-হাতিবাগান-কলেজ স্ট্রিট- নিউ মার্কেট-এ পুজো শপিঙের ভিড় ক্রমশ বাড়তে দেখে এসেছি। কলকাতার যে পাড়ায় থাকি, সেখানকার কর্মকর্তারা, আমি মুম্বই ফিরে যাব শুনে আগেভাগেই পুজোর চাঁদার রসিদ কেটে হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। খানিক এগিয়ে দেখি একটা নামী থিম পুজোর মণ্ডপ ত্রিপল দিয়ে ঢেকেঢুকে ভেতরে দারুণ কিছু কাজের প্রস্তুতি চলছে। কর্মকর্তারা এখনই কিছু ভাঙতে চাইছেন না। গোপনে চলছে মূর্তি গড়া ও আবহ তৈরির কাজ। প্রতি বছর এক থেকে দশের মধ্যে শারদসম্মান এদের বাঁধা। আগের ট্রফিগুলো তো আর এমনি ক্লাবে আসেনি। প্রতিবছর অনেক ঘাঁটঘোঁট বেঁধে এঁরা তৈরি হন। সেখানেও কিছু চাঁদা খসল। কাজের মাসি, ধোপা, সুইপার, পেপারের হকার, সবার জন্য পুজোর অগ্রিম বখশিস। ওরাও বছরভর আশা করে থাকেন। তবে সবারই একটা আন্তরিক অনুরোধ : ‘‘এইবার পুজোটা কলকাতায় কাটিয়ে গেলে হতো না? পুজোর আগেই মুম্বই ফিরে যাবেন?’’
দুর্গাপুজোর আলোকময় উৎসবকে খুশির রঙে রাঙিয়ে দিতে সবাই তৎপর। মুম্বই হোক কী কলকাতা— পুজো মানেই ‘‘তোমার আনন্দ ওই এলো দ্বারে, এলো এলো এলো গো, ওগো পুরবাসী।’’ মা আসছেন, ঘরের মেয়ে ঘরে আসছেন। আকাশে-বাতাসে তখন কেবলই আগমনির সুর। হাতে গোনা পাঁচ দিন পরই তো মহালয়া। দেবীপক্ষের শুরু। তারপর আর মাত্র ক’টা দিন। ফিবছর চেনা ছবিটাই ফিরে ফিরে আসে। মাতৃবন্দনার কাল সমাগত। দেবী মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পূজিতা হবেন। এই পুজো অকালবোধন। রাবণ বধের উদ্দেশ্যে দশরথ-পুত্র রঘুপতি রাম অকালে ১০৮টি নীলপদ্ম অর্ঘ্য দিয়ে দেবীকে উদ্বোধিত করেন। শরৎকালীন পুজোটা তাই অকালবোধন নামে খ্যাত।
পিতা হিমালয় মাতা মেনকাদেবীর আহ্বানে কৈলাস থেকে ধরাধামে মাত্র ক’টা দিনের জন্য উমা মর্তে আসেন। সৃষ্টির আদি থেকে তিনিই আদ্যাশক্তি মহামায়া। মেনকাদুলালী উমা অন্য রূপে দুর্গা। যে শক্তিকে জানা যায় না, দুর্জ্ঞেয় তিনিই দুর্গা নামে পরিচিত। শ্রীচণ্ডীতে উল্লেখ পাই ‘আরাধিতা সৈব নৃনাং ভোগ স্বর্গাপবর্গদা’। শাস্ত্রে একটা পৌরাণিক কাহিনির কথা মহিষাসুরমর্দিনীতে বর্ণিত আছে। কোলা নামে এক রাজধানী শহরের রাজা ছিলেন সুরথ। একসময় কাশ্মীর প্রদেশের যবন সম্প্রদায়রা রাজা সুরথের রাজ্য আক্রমণ করেন। অতি বিক্রমশালী রাজা সুরথ যুদ্ধে পরাজিত হন। এ দিকে নিজ রাজ্যেও দুষ্ট অমাত্য ও আত্মীয়দের দ্বারা প্রতারিত হয়ে অরণ্যে পালিয়ে আসেন। মেধম নামে এক ঋষির আশ্রমে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সে সময়ে মেধম ঋষির আশ্রমে সমাধি নামে এক বৈশ্যও আশ্রিত ছিলেন। প্রচুর ধনবান হওয়া সত্ত্বেও তিনিও নিজের স্ত্রী-পুত্রদের কাছে প্রতারিত হয়েছিলেন। তারাও ধনলোভে তাকে পরিত্যাগ করেছিলেন। মেধম ঋষির কাছে তারা নিজেদের কাহিনি ব্যক্ত করলেন। মেধম ঋষির মহাশক্তির কথা রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্যের কাছে ব্যক্ত করলেন। মধু-কৈটভ বধের কাহিনি, মহিষাসুর বধের কাহিনি এবং তৃতীয়টি হল শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের কাহিনি।
মহামায়ার বৃত্তান্ত শুনে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য চৈত্র মাসে দেবী দুর্গার মূর্তি নির্মাণ করে ধুপধুনো দীপ হোম যজ্ঞ নৈবেদ্য-সহ এক নদী তীরে ভক্তিভরে পুজো করলেন। তিন বছর ধরে সংযত মনে দেবী পুজোয় দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাঁদের দেখা দিলেন। বস্তুত মূর্তি পুজোর প্রচলন করেন তাঁরাই। স্তব স্তুতি ভক্তিতে সন্তুষ্ট দেবী আবির্ভূতা হয়ে বললেন, ‘হে রাজন ও হে বৈশ্যকুল নন্দন তোমরা আমার কাছে বর প্রার্থনা করো।’ এই কথায় রাজা সুরথ জন্মান্তরে সাবর্ণী মনু রূপে জন্মলাভ করে স্থায়ী ও এই জন্মে নিজের বিক্রমে শত্রু নিধন করে হৃত স্বরাজ্য প্রার্থনা করলেন। এবং সমাধি বৈশ্য দেবীর কাছে স্ত্রীপুত্রাদি সংসারের বাঁধন থেকে মুক্তিলাভের বর চাইলেন। মহামায়া দেবী চণ্ডীকা দুই জনকেই তাঁদের মনোমত বর দানে তুষ্ট করেন।
আমাদের বহু শ্রুত সেই মেধম ঋষি, রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্যর কাহিনি থেকে এই মূল সত্যটিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে ভক্তি সহকারে দেবী দুর্গার আরাধনা করলে, যে ভোগই হোক অথবা ত্যাগই হোক, দেবী সম্তুষ্ট হয়ে বরদান ও আশীর্বাদ করেন। শ্রীশ্রীচণ্ডী ১/৫২ শ্লোকে দেবী মাহাত্ম্য উল্লেখ আছে—‘যা বিদ্যা পরমা মুক্তোর্হেতুভূতা সনাতনী/সংসার বন্ধ হেতৃশ্চ সৈব সর্বেশ্বরশ্বরী।’ দার্শনিক তর্জমা করলে, তিনি যেমন সংসার বন্ধনের কারণ স্বরূপ অবিদ্যা আবার তিনিই অপর দিকে সংসার-বন্ধন-মুক্তির কারণস্বরূপা ব্রহ্নবিদ্যা সর্বেশ্বরীও।
যাই হোক, এই সব তো হল পুরাণ কথা ও দার্শনিক তত্ত্বকথা। আমরা অতশত বুঝি না বাপু। আমরা সাধারণ আপামর বাঙালি, এটাই বুঝি যে বচ্ছর ভর অপেক্ষার প্রহর শেষ করে জগৎ জননী মা আসছেন মর্ত্যে। নিত্যনৈমিত্তিক যাপনের যাবতীয় খারাপ লাগা, কটু ও বিমর্ষ লাগা বিষয়গুলোকে আপাত ভাবে দূরে সরিয়ে রেখে বাঙালি এই সময়টাই আনন্দযজ্ঞে মেতে উঠবে। উৎসবের আনন্দে, বনেদিয়ানায় প্রতি বছরই নির্ধারিত পুজোর ক’টা দিন নতুন উদ্যমে মেতে থাকে বাঙালি। দুগ্গাপুজো বাঙালির কাছে এক বিপুল মহোৎসব যে। কর্মসূত্রে যে যেখানেই থাকুক, বাড়ি থেকে দূরে বা প্রবাসে অথবা আরও দূরে, সে তার সুবিধা-সাধ্য-সুযোগের কিছুটা মেলবন্ধন ঘটিয়ে তৎপর থাকে ঘরে ফেরার। সেখানেই তো তার পুরোনো পাড়া, পুরোনো বন্ধু, আত্মীয় পরিজন। পাড়ায় পুরোনো বন্ধুরা একজোট হয়ে
খানিক ফুর্তি হুল্লোর খাওয়া-দাওয়া জমাটি আড্ডা।
এ দিকে তো সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ জুড়ে অপলোড হচ্ছে মাঠেঘাটে কাশফুলের ছবি, কুমোরটুলির অর্ধসমাপ্ত মৃণ্ময়ী মূর্তির ছবি, শরৎ আকাশের মারকাটারি সাদা মেঘের ছবি, ঝুড়িতে সাজানো কমলা সাদা একগুচ্ছ শিউলি ফুলের ছবি, ম্যারাপ বাঁধা অসমাপ্ত প্যান্ডেলের ছবি ইত্যাদি। নস্টালজিক করে দেওয়া আগাম যে সব ছবি দেখে বাঙালির মনে নতুন খুশির ঝলক। আসলে ইদানীং শারদোৎসবও যেন হুজুগপ্রিয় বাঙালির কাছে যতটা না ধর্মীয় উৎসব তার থেকে অনেক বেশি যেন সামাজিক ব্যাঞ্জনাময় একটা বিপুল উৎসব হয়ে ওঠে।
মহালয়ার আগে এই প্রতিবেদনটা লিখতে বসে আবার কেমন স্মৃতিকাতর হয়ে উঠি। সেই যে ঘুম ঘুম চোখে অথবা আধো ঘুম আধো তন্দ্রাচ্ছন্ন শারদপ্রাতে কানে ভেসে আসত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র অমর বেতারভাষ্য। ভোররাত থাকতেই বাড়ির টেবিলঘড়িতে অ্যালার্ম লাগিয়ে রাখা হত। তার পর রেডিয়ো খুলে খানিক অপেক্ষা। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র-পঙ্কজ কুমার মল্লিক-বাণীকুমার ত্রয়ীর সারস্বত নিবেদন ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর জলদ গম্ভীর উদাত্ত উচ্চারণ—অমোঘ কথন, স্তোত্র ও শ্লোক সম্বলিত পুরাণকথা। মাতৃবন্দনা ও চণ্ডীপাঠ। তারই গ্রন্থনার মাঝে তাবড় তাবড় সে যুগের শিল্পীদের কণ্ঠে সেই যে, সেই সমস্ত কোনও দিনও পুরোনো না হওয়া গীতিআলেখ্য। চিরকালীন মহালয়ার গানগুলিও প্রতি বছর শুনে শুনে আমাদের প্রায় কণ্ঠস্থ। শৈশব কৈশোরের একটা খণ্ড মুহূর্ত সময়ের সীমা পেরিয়ে আবারও ধরা দেয় মনের মধ্যে।
আবার প্রসঙ্গক্রমে ফিরে যাই পুরাণকথায়। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে এবং মহিষাসুরমর্দিনীর বেতার ভাষ্য থেকে আমরা জানতে পারি, পুরা কালে দেবতা এবং অসুরদের মধ্যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধে দেবতারা পরাজিত হন এবং অসুররা স্বর্গরাজ্য থেকে দেবতাদের বিতারিত করে স্বর্গরাজ্য অধিকার করে নেয়। দেবগণ ভগবান ব্রহ্মাকে সামনে রেখে ভগবান শিব ও বিষ্ণুর কাছে তাদের দুর্দশার কথা ব্যক্ত করলেন। দেবাদিদেব মহাদেব ও বিষ্ণু সব শুনে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। তাদের মুখমণ্ডল থেকে মহাতেজ বেরিয়ে এল। সমস্ত তেজ একত্রিত হল তখনকার প্রখ্যাত ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে। তিনি তখন কঠিন তপস্যায় মগ্ন। বেতারভাষ্যে উল্লেখ আছে, ‘কাত্যায়নাশ্রমে দেবগণ সেই সুদীপ্ত তেজোপুঞ্জকে দিগন্তব্যাপী জ্বলন্ত পর্বতের মতো অবস্থিত দেখলেন’।
শিবের তেজে নারীমূর্তির মুখমণ্ডল, যমের তেজে কেশপাম, বিষ্ণুর তেজে বাহু, চন্দ্রের তেজে যুগল স্তন, ইন্দ্রের তেজে শরীরের মধ্যভাগ, বরুণের তেজে উরুদ্বয় ও জঙ্ঘা, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, বহ্নির তেজে ত্রিনয়ন, দক্ষ প্রজাপতিগণের তেজে দন্তরাশি সৃষ্টি হয়েছিল। সমস্ত তেজ এক সঙ্গে মিলে অপরুপা দেবীমূর্তি ধারণ করলেন এবং তিনিই হলেন জগন্মাতা মা দুর্গা দুর্গতিনাশিনী। যেহেতু ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমেই এই সুন্দরী দেবীর জন্ম হয়েছিল তাই তার অপর নাম দেবী কাত্যায়নী। তার পর দেবতারা সেই তেজস্বিনীকে উপহার দিলেন নিজেদের অস্ত্রের অনুরূপ আরও এক একখানি অনুরূপ অস্ত্র। যেমন মহাদেব দিলেন তাঁর নিজের ত্রিশূলের মতোই একটি ত্রিশূল। বিষ্ণু সেই রকমই সুদর্শনচক্র, বিশ্বকর্মা কুঠার, নাগরাজ বাসুকি নাগপাস, ইন্দ্র দিলেন বজ্র, কালদেব খড়্গ, সূর্য দিলেন ধনুর্বান, চন্দ্র দিলেন অর্ধচন্দ্র, কুবের দিলেন চন্দ্রহার।
তবে, কেবল মাত্র অস্ত্র নয়। রমণী হিসেবে তিনি উপহার পেলেন নানান অলঙ্কার। যেমন চন্দ্র দিলেন ললাটভূষণ, এ ছাড়াও বলয়, কণ্ঠভূষণ ও অঙ্গুরী। সমুদ্রও দিলেন নানা প্রকার রত্ন অলঙ্কার ও বস্ত্র। হিমালয় দিলেন বাহন করার জন্য একটি সিংহ। কুবের দিয়েছিলেন একটি পানপাত্র। যে পানপাত্রের সুরা খালি হলেই আবার তখনই ভরে উঠবে। অলঙ্কার ভূষণ অস্ত্রে শোভিতা দেবী এ বার অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন। সেই হর্ষ উচ্ছ্বাস শ্রবণ করে দেবতারাও দেবীর জয়ধ্বনি করতে লাগলেন। ও দিকে দেবীর প্রচণ্ড হাসি শুনে মহিষাসুর সেই হাসির উৎস সন্ধানে সেখানে উপস্থিত হলেন। পরমা সুন্দরীকে মহিষাসুর প্রেম নিবেদন ও বিবাহ প্রস্তাব করে বসলেন। ‘দেবী ভাগবতম’ এই প্রেম নিবেদন ও প্রত্যাখ্যানের বিষদ বিবরণ আছে। দেবী প্রবল পরাক্রমে বহুক্ষণ যুদ্ধের পর রুদ্রমূর্তি ধারণ করে মহিষাসুরের নিধন করেন।
এমনই নানান পৌরাণিক আখ্যানের কথা শুনে শুনে আমরা ঝালিয়ে নিই আমাদের মাইথোলজি জ্ঞানের ভান্ডার। মহিষাসুরমর্দিনীর গোটা নাট্যকল্পটিই শুনে শুনে আমাদের মনে গেঁথে যায়। শরৎকালের অপূর্ব প্রকৃতির পরিমণ্ডলে তখন নিপাট সাবেকি সৌন্দর্য। আগমনীরই আর এক রূপ দেবীর ওই জগজ্জননী রূপটি। গণেশজননী, কার্তিকজননী, নিজে মা হয়েও মায়ের কাছে শুনে এসেছেন মেয়ে হয়ে। দেবী একই অবয়বে জননী-জায়া-কন্যা। ভূ-কৈলাসে ছড়িয়ে পড়ে মায়ের আগমনী গান। ক্ষয়িষ্ণু মানুষ মানসিক শক্তি আহরণ করে দেবীর আবাহন মন্ত্রে। যা কিছু গ্লানি, জড়তা, হীনতা সব কিছু দিনের জন্য হলেও ঘুচে যায়। শারদ অর্ঘ্যে শুচি হয় মন। মা আমাদের শুভ শক্তি প্রদান করুন এই প্রার্থনাই থাকে জনগণের মনে। দুর্গার চরণে আত্মনিবেদন করতে চায় আমাদের বৈষয়িক, টানা ও পোড়েন নিয়ে দৈনন্দিন জীবনে। দশপ্রহরিনী দুর্গার অসুরদলনী তেজ ও বিভিন্ন আযুধের দ্বারা সমাজ সংসারে যাবতীয় হীনতা অপূর্ণতা, দুর্বিপাক, দুঃখ-দুর্দশার অবসান ঘটিয়ে নতুন শান্ত সুসংহত জীবনের প্রার্থনা ধ্বনিত হয় মানব মনে। এক জাগতিক ঐক্য সুদৃঢ় করার, জাগ্রত করার চেতনা তৈরি হয়। সুধী পাঠক। আসুন। আসন্ন শারদোৎসবের প্রাক্কালে আমরা সবার জন্য প্রার্থনা করি ভাল থাকার, সুস্থ থাকার, শান্তিতে থাকার। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অসীম শক্তিরূপিনী সসীম মাতা দুর্গার মৃণ্ময়ী মূর্তিকে ‘মা’ ডাকে পৃথিবীতে আহ্বান করি। মৃণ্ময়ী প্রতিমার মধ্যেই তো চিণ্ময়ী মা সর্বতোভাবে বিরাজ করেন। মহালয়ার শুদ্ধ ভোরে আরও একবার মনে মনে পাঠ করি মাতৃমন্ত্র। যা আমাদের চেতনাকে পবিত্র হতে শেখায় শারদোৎসবের হাত ধরে। তিনি সর্বভূতে চেতনারূপে বিরাজিত
‘যা দেবী সর্বভূতেষু চেতনেত্যভিধীয়তে’।
সেই মৃণ্ময়ী মূর্তি চিণ্ময়ী ভাবনায় আরাধনা হবে বারোয়ারিতে, দেবীমণ্ডপে, পাড়ার প্যান্ডেলে অথবা বনেদি বাড়ির ঠাকুরদালানে।
পুজোর উৎসবমুখর দিনগুলো সবার ভাল কাটুক, আনন্দে কাটুক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy