বিপন্ন: এ ভাবেই কাজ বাজি কারখানায়। নিজস্ব চিত্র
ছোট হাতের তালুতেই ভরসা রাখেন বাজি কারবারিরা!
কারণ ভরা মরসুমে দিন-রাত এক করে কাজ করার পরেও কোনও বায়নাক্কা করে না ‘ওরা’। ‘ওরা’ অর্থাৎ, দক্ষিণ শহরতলির বাজি কারখানার শিশু শ্রমিকেরা। শুধু কালীপুজো নয়, নানা উৎসবে শব্দবাজির চাহিদা থাকে বছরভর। আর সেই চাহিদা মেটাতে কম খরচে বাজি তৈরির এই সুযোগটাকেই পুরোদস্তুর কাজে লাগান কারাখানার মালিকেরা।
শব্দবাজির আঁতুড়ঘরে শিশু শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানোর অভিযোগ রয়েছে ভুরি ভুরি। শিশু শ্রমিকেরা যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বছরভর চকলেট বোমা তৈরি করে, তা অকপটে স্বীকার করেন কারখানার মালিকেরাই। জানান, ওদের অধিকাংশই স্কুলপড়ুয়া। মিড ডে মিলের টানে স্কুলে যায়। তার পর দুপুরেই হাজির হয় কারখানায়। কখনও কখনও ওদের বাড়ির লোকেরাই পৌঁছে দিয়ে যান কারখানার দরজায়। একাধিক বাজি কারখানার মালিক রীতিমতো গর্বের সুরেই দাবি করলেন, ‘‘এখন শিখিয়ে পড়িয়ে এমন করে নিয়েছি যে বাজি তৈরিটা ওদের নেশার মতো হয়ে গিয়েছে।’’
এক মালিকের দাবি, জোর করে নয়, ওরা নিজেরা ফূর্তিতেই চকলেট তৈরি করে। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা বাজি তৈরির বরাত না দিলে মাথা খেয়ে নেবে ওরা।’’ আর মালিকেরাও ব্যবসা বোঝেন। তাঁদের বক্তব্য, ছোট হাত-ছোট মাথা হলে কী হবে? একেবারে ১০০ শতাংশ কারিগর ওরা। মশলার মিশেলের ভাগ হোক বা বাঁধন, সব ক্ষেত্রেই একশোয় একশো পাওয়ার মতো হাতের কাজ নাকি ওদের।
কারখানা চত্বরেই দেখা মিলল অষ্টম শ্রেণির ছাত্র পল্টুর (নাম পরিবর্তিত)। বছর চারেক ধরে নানা কারখানায় চকলেট তৈরি করছে সে। বাবা দিন মজুরের কাজ করেন। পল্টুরা দুই ভাই এক বোন। জানায়, একশো চকলেট তৈরির মজুরি ১০ টাকা। মরসুমে দিন-রাতে প্রায় হাজার পাঁচেক চকলেট তৈরি করা বাঁ-হাতের কাজ তার। ঠিক করে নিয়েছে, বাজি তৈরির টাকাতেই বোনের বিয়ে দেবে। ভাইকেও পড়াবে। কারখানার মালিক বলেন, ‘‘পল্টু একা নয়। একটা বড় দল রয়েছে। সকলেই কাছাকাছি বয়সী। নানা কারখানায় বরাত নিয়ে কাজ করে ওরা।’’ আর এক বাজি শ্রমিক সপ্তম শ্রেণির পিকলু জানাল, তার সব বন্ধুই মোটামুটি চকলেট তৈরি করতে পারে। একজনের হাত উড়ে গিয়েছিল। তার পর সে আর পারে না। তার ১০ বছরের ভাই এখন কারখানায় আসে।
কিন্তু এত ঝুঁকির কাজ করে কেন এই শিশুরা? উত্তর দেয় আর এক কারিগর। এলাকারই অন্য এক কারখানায় কাজ করা বছর বারোর বুবলা বলে, ‘‘আমি যেটা তৈরি করি সেটা যখন জোরে ফাটে, তখন ‘হেব্বি’ লাগে। আপনিও তৈরি করুন। জোরে ফাটলে খুব মজা হবে দেখবেন।’’
এই ‘জোরে ফাটা’ বাজি তৈরি করতে গিয়েই অকালে ঝরে যায় অনেক জীবন। অনেকের হাত উড়ে যায়। গোটা জীবনের মতো দৃষ্টি হারায় বহু শিশু। নোবেলজয়ী সমাজকর্মী কৈলাস সত্যার্থীও একাধিক বার এই বাজি কারখানার শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। দক্ষিণ ২৪ পরগণার একাধিক কারখানায় ঘুরে জানা গিয়েছে, শুধু কারখানায় কাজই নয়, মজুরির টাকা জমিয়ে নিজেরা মশলা কিনেও বাজি বানায় ওরা। সে সব বাজি আলাদা করে বিক্রিও করে উৎসবের মরসুমে। এখানেই শেষ নয়, পুলিশের চোখ এড়িয়ে চুপি চুপি তা ক্রেতাদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কাজও করে ওরা। কোনও কিছুতেই ‘না’ নেই ওদের। বরং অনেকের কাছেই এটা একটা নেশার মতো হয় দাঁড়িয়েছে।
আর এই নেশাই লাভের মুখ দেখায় কারখানা মালিকদের। তাঁদের কেউ কেউ জানান, সাধারণ শ্রমিকদের নানা টালবাহানা রয়েছে। দিনে তিনশো থেকে পাঁচশো টাকা মজুরি। তার উপরে তিন বেলা খাবারের টাকা অতিরিক্ত। সে জায়গায় অধিকাংশ শিশু শ্রমিককে দিনে তিনশো টাকা দিলেই মহা খুশি। নয় তো একশো চকলেটের হিসেবে মজুরি।
ব্যস, কচি হাত রাসায়নিক মশলায় ধূসর হয়ে উঠতে দেরি লাগে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy