Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

নিরঙ্কুশে মরিয়া তৃণমূল, জমি ফেরাতে মাঠে বাম

গায়ে ‘কলকাতার দলে’র তকমা সেই জন্মলগ্ন থেকেই। এই এখনও রাজ্য মন্ত্রিসভায় শুধু কলকাতা থেকেই এক ঝাঁক মুখ! কলকাতা-কেন্দ্রিক দল হিসাবে যাদের পথ চলা শুরু, কলকাতার ভরসা তাদের উপরেই আছে কি না— এই প্রশ্নের উত্তর দিতেই আজ, শনিবার ভোটের লাইনে দাঁড়াবে মহানগর!

যন্ত্রপরীক্ষা। ভোটের আগের দিন হেয়ার স্কুলে। —নিজস্ব চিত্র।

যন্ত্রপরীক্ষা। ভোটের আগের দিন হেয়ার স্কুলে। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:০৬
Share: Save:

গায়ে ‘কলকাতার দলে’র তকমা সেই জন্মলগ্ন থেকেই। এই এখনও রাজ্য মন্ত্রিসভায় শুধু কলকাতা থেকেই এক ঝাঁক মুখ! কলকাতা-কেন্দ্রিক দল হিসাবে যাদের পথ চলা শুরু, কলকাতার ভরসা তাদের উপরেই আছে কি না— এই প্রশ্নের উত্তর দিতেই আজ, শনিবার ভোটের লাইনে দাঁড়াবে মহানগর!

কে জিতবে, তার উত্তর পেতে অপেক্ষা আরও ১০ দিনের। কিন্তু জয়-পরাজয়ের মীমাংসার চেয়েও শহরের জনতাকে এ বার বেশি ভাবাচ্ছে অন্য একটা প্রশ্ন। ভোটটা শান্তিতে হবে তো? ভোটের দিন যত এগিয়েছে, তত পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অশান্তির ঘটনা। কোথাও বিজেপি, কোথাও কংগ্রেস নেতা-প্রার্থীরা আক্রান্ত হয়েছেন। আবার প্রচারের একেবারে শেষ লগ্নে বেশি আক্রমণ হয়েছে বামেদের উপরে। মাত্র তিন কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং বাকি রাজ্য পুলিশের ভরসায় সুষ্ঠু ভাবে ভোটের দিনটা উতরোবে কি না, সংশয় তাই স্বাভাবিক।

অথচ ভোটের হাওয়া মাপতে গেলে এমন অশান্তি-হানাহানিই অস্বাভাবিক! কারণ, ধারে-ভারে তৃণমূল অনেক এগিয়ে। সংগঠনেও বিরোধীদের সঙ্গে তাদের ফারাক বিস্তর। আর এই সাধারণ ধারণাকেই আরও একটু দৃঢ় করে তুলেছে ভোটের মুখে জনমত সমীক্ষা। এক মাসের ব্যবধানে দু’বার শহরবাসীর মন বুঝতে গিয়ে সমীক্ষক সংস্থা দেখেছে, শতাধিক আসন পেয়ে কলকাতার ছোট লাল বাড়িতে তৃণমূলের ক্ষমতা ধরে রাখার ইঙ্গিত স্পষ্ট। তা হলে তাদের বিরুদ্ধে এত অশান্তি ছড়ানোর অভিযোগ আসছে কেন?

কেউ বলছেন, শাসক দল আসলে চাইছে জয়কে নিরঙ্কুশ করে তুলতে! তাই যেখানে যেখানে বিরোধীদের সামান্য প্রভাবও দেখা যাচ্ছে, সেখানেই হামলার অভিযোগ আসছে। গত বছরের লোকসভা ভোটের ফলাফলের নিরিখে তৃণমূল কলকাতায় শ’খানেক ওয়ার্ডে এগিয়ে থাকলেও দু’টি বিধানসভা কেন্দ্রে তারা পিছিয়ে ছিল। উত্তর কলকাতায় জোড়াসাঁকো এবং দক্ষিণে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর কেন্দ্র ভবানীপুর! দুই কেন্দ্রেই ফুল ফুটেছিল বিজেপির। তৃণমূল নেতৃত্বের সামনে চ্যালেঞ্জ, এক বছরের মাথায় অন্য সব রং মুছে দিয়ে ফের জোড়া ফুলের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘গন্তব্যে নিরাপদে পৌঁছে গেলেও লোকসভা ভোটে রাস্তায় কিছু খানা-খন্দ ছিল। এ বার রাস্তা একেবারে মসৃণ করতে হবে! দেখতে হবে, বিধানসভা ভোটের আগে আর যাতে গর্ত না হয়!’’ একই সঙ্গে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশ মেনে নিচ্ছেন, ‘‘এ ভাবে বিরোধীশূন্য করে জিততে চেয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলার পরিণাম ভবিষ্যতে ভাল হবে না!’’ অতীতে বামেদের আধিপত্য দেখাতে যাওয়ার পরিণতি কী হয়েছে, তা দেখেই তাঁদের এমন আশঙ্কা।

পাশাপাশি, আরও একটা বিষয় চর্চায় উঠে আসছে। বাহুবলী বাহিনীর উপরে তৃণমূল নেতৃত্বের যে কার্যত কোনও নিয়ন্ত্রণই নেই, এ বার পুরভোটের মুখে কলকাতার ছবিই তার স্পষ্ট ইঙ্গিত। বিরোধীদের উপরে আত্রমণ অন্যায় হচ্ছে জেনেও অনেক ক্ষেত্রে দলীয় নেতারা ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেন না। আবার একই রকম ভাবে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়ছে দলেরই দুই গোষ্ঠী! যেখানে যেখানে শাসক দলের মধ্যে বিক্ষুব্ধ অংশ নির্দল বা গোঁজ প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে, সেখানে উত্তেজনা আরও বেশি। একে অপরকে চাপে রাখতে দু’পক্ষই গোলমালের রসদ সংগ্রহ করছে। গুন্ডারা নেতা না নেতারা গুন্ডা, কখনও ধারণাটাই গুলিয়ে যাচ্ছে!

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভয় না দেখালে নিরঙ্কুশ জয় আসবে না— এমনটাই বা শাসক দলকে ভাবতে হচ্ছে কেন? শাসক এবং বিরোধী, দুই শিবিরের অভ্যন্তরেই আলোচনা, বামেদের কিছুটা জমি ফিরে পাওয়ার ইঙ্গিত তৃণমূলের আশঙ্কা বাড়িয়েছে। সর্বশেষ জনমত সমীক্ষাতেও দেখা গিয়েছে, তৃণমূল ৪৪% ভোট পেয়ে এবং শতাধিক ওয়ার্ডে জিতে কলকাতার ছোট লাল বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করতে পারে। কিন্তু বামেরাও পেতে পারে ৩০% ভোট। বিজেপি-র হাওয়া ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসছে বলেও সমীক্ষার ইঙ্গিত। তৃণমূলের অন্দরের ভাবনা, বিজেপি এখনও এ রাজ্যে সংগঠিত দল নয়। তারা কিছু ভোট কম-বেশি পেলে বিরাট কিছু এসে যায় না তৃণমূলের। কিন্তু বহু ভাঙনের পরেও বামেরা এখনও কিছুটা সংগঠিত। তারা কলকাতা শহরে ৩০% ভোট পেয়ে যাওয়া মানে আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচনের আগে নতুন অক্সিজেনের সন্ধান। তৃণমূলের এক প্রবীণ নেতার কথায়, ‘‘গত কয়েকটা নির্বাচনে আমরা হেসেখেলে জিতেছি ভোট

ভাগাভাগির খেলায়। কিন্তু অন্য ভাবে দেখলে আমাদের মাথার উপরে খাঁড়া ঝুলছে! বামেরা এখানে ৩০% ভোট পাওয়া মানে সামনে বড় বিপদ!’’ এই বিপদের ভাবনাই রক্তপাতের পথ প্রশস্ত করছে।

তৃণমূলের কাছে যেমন নিরঙ্কুশ জয়ের চ্যালেঞ্জ, বামেদের সামনে এ বার তেমনই ‘ঘর ওয়াপসি’র পরীক্ষা! বিজেপি-র দিকে চলে যাওয়া ভোটের কিছুটা বামেরা ঘরে ফেরাতে পারবে কি না, সেটাও অন্যতম কৌতূহল। পঞ্চায়েত এবং লোকসভা নির্বাচনে সে ভাবে কর্মী-সমর্থকদের বাহিনীকে শাসক দলের মোকাবিলায় ময়দানে নামাতে পারেননি বাম নেতৃত্ব। এ বার শুরু থেকেই বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্রেরা রুখে দাঁড়ানোর ডাক দিয়ে রেখেছেন। ভোটের মুখে হামলা বাড়ছে দেখে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ‘সঙ্ঘবদ্ধ ও সর্বাত্মক প্রতিরোধে’র আহ্বান জানিয়েছেন। বুথে বুথে ভোট লুঠ আটকাতে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরি হচ্ছে। সামগ্রিক ভাবে বামেদের মনোভাব এ বার অনেক বেশি আক্রমণাত্মক। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যবাবুর কথায়, ‘‘আত্মসমর্পণ নয়! মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এর মোকাবিলা হবে।’’

কী অবস্থা বিজেপির? গত লোকসভা ভোটে বাকি রাজ্যের মতো কলকাতা শহরে সাড়া জাগিয়েও সংগঠনে নজর না দেওয়ার মাসুল গুনতে হচ্ছে তাদের! স্থানীয় স্তরে সংগঠন গড়ে তোলা যায়নি, উল্টে পুরভোটের প্রার্থী বাছাই নিয়ে মারপিট, লেঠেল বাহিনী দিয়ে নিজেদের কর্মীদের উপরেই বিজেপির আক্রমণ তাদের ভাবমূর্তির ক্ষতি করেছে। সে দিকে না ভেবে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি আঁকা বা তাঁর ভাইপোর ডিগ্রি ‘জালে’র অভিযোগ নিয়েই বেশি হইচই করেছেন সিদ্ধার্থনাথ সিংহের মতো বিজেপি নেতারা। জনমত সমীক্ষায় অবশ্য দেখা গিয়েছে, দুর্নীতির অভিযোগের ভিত্তিতে রায় দেবেন কি না, এই প্রশ্নে হ্যাঁ-না বলেছেন সমসংখ্যক মানুষ। তবু সারদা-কাণ্ডের ছায়ায় পঞ্চায়েত, লোকসভা এবং উপনির্বাচন হয়েও তৃণমূল বিশেষ ধাক্কা খাচ্ছে না দেখে পুরভোটে বিরোধীদের কৌশল পাল্টানো উচিত ছিল বলে মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ।

সিদ্ধার্থনাথ বা রাহুল সিংহদের অবশ্য পাল্টা যুক্তি, তৃণমূলের আয়-ব্যয়ের হিসেবে গরমিল, ভুয়ো সংস্থার অনুদান— এ সব ঘটনা নিরন্তর উঠে আসছে এবং সংবাদমাধ্যমে চর্চা চলছে। চাপে পড়ে মুখ্যমন্ত্রীও পুর-প্রচারে নিজের ছবি বিক্রির হিসেব দিতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলে বিতর্কে ইন্ধন দিয়েছেন। এমতাবস্থায় তাঁরা দুর্নীতির মতো অভিযোগ ছেড়ে দেবেন কী করে? আর এক বিরোধী দল কংগ্রেসের অবশ্য কলকাতা তো বটেই, গোটা রাজ্যেই প্রায় অস্তিত্বের সঙ্কট! তাদের লড়াই অস্তিত্ব রক্ষারই।

প্রসঙ্গত, এই পুরভোটে তৃণমূলের সংগঠনকে পরীক্ষা দিতে হবে মুকুল রায়ের ‘সাজেশন পেপার’ হাতে না নিয়েই! প্রথমে চৌরঙ্গি এবং পরে বনগাঁ ও কৃষ্ণগঞ্জের উপনির্বাচনে ইতিমধ্যেই তৃণমূল নেত্রী দেখাতে পেরেছেন, তাঁর এক সময়ের বিশ্বস্ত সেনাপতির সক্রিয় ভূমিকা ছাড়াই তাঁর দল ভোটে উতরে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। তবু আরও একটু বড় আকারে এবং তৃণমূল স্তরে মুকুল-হীন নির্বাচন করার পরীক্ষা হবে এই পুরভোটেই। তৃণমূল এই পরীক্ষায় পাশ করা মানে গত ২০ বছরের রেওয়াজ ভাঙবে। গত চার বারের কলকাতা পুরভোটেই পুরবোর্ডের রং আলাদা হয়েছে। পরপর দু’বার একই দলের মেয়র চায়নি শহর। এ বার শোভন চট্টোপাধ্যায়ের প্রত্যাবর্তন মানে দু’দশক পরে রাজধানী শহরে আবার স্থিতাবস্থার পক্ষে রায়! তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘রেকর্ড আসনে জিতব আমরা! বামেরা ফিরবে না, আর বিজেপির কুঁড়িও ফুটবে না!’’

নিরঙ্কুশ জয়ের তাগিদ ভোটে শান্তি রাখে কি না, জবাব আজই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE