Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

দুই প্রধানের বদলিতে ধাক্কা প্রেসিডেন্সির

শিক্ষক-শূন্যতার সূচনা হয়েছিল কেউ কেউ ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাওয়ায়। তাতে দফায় দফায় ক্ষত ও ক্ষতি বাড়ছিল প্রেসিডেন্সির। এ বার তার উপরে এল বদলির সরকারি সিদ্ধান্তের ধাক্কা। নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর মুখে বদলি করে দেওয়া হল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধানকে। ইতিহাসের প্রধান শুক্লা সান্যালের ইস্তফা যদি হয় এ-পর্যন্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে প্রেসিডেন্সি ছেড়ে যাওয়ার শেষ ধাক্কা, বাংলার প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধান অনীক চট্টোপাধ্যায়ের বদলি তা হলে সরকারি তরফে রাম-ধাক্কা।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৫ ০৩:৪৯
Share: Save:

শিক্ষক-শূন্যতার সূচনা হয়েছিল কেউ কেউ ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাওয়ায়। তাতে দফায় দফায় ক্ষত ও ক্ষতি বাড়ছিল প্রেসিডেন্সির। এ বার তার উপরে এল বদলির সরকারি সিদ্ধান্তের ধাক্কা।

নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর মুখে বদলি করে দেওয়া হল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধানকে। ইতিহাসের প্রধান শুক্লা সান্যালের ইস্তফা যদি হয় এ-পর্যন্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে প্রেসিডেন্সি ছেড়ে যাওয়ার শেষ ধাক্কা, বাংলার প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধান অনীক চট্টোপাধ্যায়ের বদলি তা হলে সরকারি তরফে রাম-ধাক্কা।

বুধবার রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দফতর থেকে ওই বদলির নির্দেশ আসায় প্রেসিডেন্সির পঠনপাঠনের সমস্যা আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ। অথচ এই বিষয়ে তাঁরা যে অসহায়, সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়া। তিনি এ দিন বলেন, ‘‘সরকার বদলি করলে আমাদের কিছু করার নেই। কিন্তু শীঘ্রই স্নাতক স্তরে ছাত্র ভর্তি শুরু হবে। ঠিক এই সময়েই দু’-দু’জন বিভাগীয় প্রধান চলে গেলে আমরা কী ভাবে কাজ সামলাব, তা নিয়ে উদ্বেগে রয়েছি।’’

বাংলার বিদায়ী প্রধান দেবপ্রিয়বাবু এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিদায়ী প্রধান অনীকবাবু অবশ্য এই বদলির বিষয়ে মুখ খোলেননি। প্রেসিডেন্সিতে দর্শনের প্রধান হিসেবেও অতিরিক্ত দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন অনীকবাবু।

প্রেসিডেন্সিতে পর্যাপ্ত পরিকাঠামো এবং প্রত্যাশিত পারিশ্রমিক না-পাওয়ায় শিক্ষকদের চলে যাওয়া শুরু হয়েছে অনেক দিন আগেই। সেই থেকে শিক্ষক-ঘাটতিতে চলছে ওই নামী প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকের অভাবে ধুঁকতে থাকা প্রেসিডেন্সিতে পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে বলে বিভিন্ন মহলের অভিযোগ। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, ৩০৬টি শিক্ষক-পদের মধ্যে প্রায় ১৫০টি ফাঁকা। দর্শন, বাংলা, অর্থনীতি, রসায়ন-সহ বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষকের অভাব প্রকট। শ’খানেক অতিথি শিক্ষক দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা হলেও তাতে পঠনপাঠন ব্যবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্তা জানান, মাস পাঁচেক আগে ১৪২টি শিক্ষক-পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হলেও সেই প্রক্রিয়া শেষ হতে আরও মাস দুয়েক লাগবে। এর মধ্যে এল শিক্ষক বদলির ধাক্কা।

আবার সরকারি কলেজগুলিতে শিক্ষকের যে যথেষ্ট অভাব আছে, সে-কথা এ দিন বিধানসভায় স্বীকার করে নিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও। মন্ত্রীর সেই বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই প্রেসিডেন্সির দুই শিক্ষক দেবপ্রিয়বাবু ও অনীকবাবুর বদলি প্রসঙ্গে উচ্চশিক্ষা দফতরের এক কর্তার যুক্তি, ১৫ জুনের মধ্যে ২৬টি নতুন সরকারি কলেজে কাজ শুরু করতে হবে। সেই জন্য নতুন পদে এখনও শিক্ষক দেওয়া যায়নি। এই অবস্থায় নতুন কলেজে পাঠ শুরু করার জন্য তড়িঘড়ি শিক্ষকদের বদলি করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্সির দুই শিক্ষকের বদলিও সেই কারণেই।

এই সরকারি ব্যাখ্যায় অবশ্য অনেকেই সন্তুষ্ট নন। ইতিহাসের প্রধান শুক্লাদেবী ছেড়ে যাওয়ার পরে জানিয়েছিলেন, বিভাগ পরিচালনার প্রশ্নে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নানা বিষয়ে মতবিরোধের জেরেই তিনি ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দেবপ্রিয়বাবু ও অনীকবাবুর বদলি নিয়ে এ দিন তেমন কোনও শোরগোল না-হলেও প্রেসিডেন্সিতে কর্মরত অনেক শিক্ষকেরই আশঙ্কা, তাঁদেরও অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হতে পারে। এমনই এক শিক্ষকের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন রেজিস্ট্রার প্রবীর দাশগুপ্তকে গত অগস্টে বদলি করা হয়েছিল বিশেষ কারণে। ২০১৩-র এপ্রিলে প্রেসিডেন্সির মূল ফটক ভেঙে ভিতরে ঢুকে তাণ্ডব চালানোর অভিযোগ ওঠে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের বিরুদ্ধে। সেই ঘটনায় তৎকালীন দ্বাররক্ষী পাপ্পু সিংহকে থানায় ডেকে পুলিশ হেনস্থা করে বলে অভিযোগ ওঠে। অথচ সেই পাপ্পুর পাশে দাঁড়ান প্রবীরবাবু। এতেই তাঁর উপরে খড়্গহস্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয় বলে অনেকের অভিমত।

প্রবীরবাবু, দেবপ্রিয়বাবু ও অনীকবাবুদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে জনা ৪০ শিক্ষক আছেন, যাঁরা আদতে ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষক। প্রেসিডেন্সি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়, তখন ‘অপশন ফর্ম’ পূরণ করে তাঁরা সরকারি কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। পরে নির্দিষ্ট বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁদের চাকরি পাকা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সরকার রিলিজ বা ছাড়পত্র না-দেওয়ায় তাঁরা কাগজে-কলমে এখনও সরকারি কর্মচারীই থেকে গিয়েছেন। তাই সরকার চাইলেই তাঁদের অন্যত্র বদলি করে দিতে পারে।

প্রশ্ন উঠছে, এত দিনেও রিলিজ বা ছাড়পত্র দেওয়া হয়নিই বা কেন?

শিক্ষামন্ত্রী পার্থবাবু আগেই জানিয়েছিলেন, ওই শিক্ষকদের প্রত্যেকের ‘ফাইল’ আলাদা ভাবে বিচার করা হচ্ছে। তার পরেই রিলিজের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এই কাজে সময় লাগবে। কিন্তু সরকারি কলেজের শিক্ষকদের বদলির ক্ষেত্রে শাসক দলের ‘কাছের লোকেদের’ পুরস্কৃত করে অন্যদের দূরে ঠেলে দেওয়ার অনেক নজির রয়েছে তৃণমূল সরকারের আমলে। এ দিন দুই বিভাগীয় প্রধানের বদলির ক্ষেত্রেও তাই প্রশ্ন উঠেছে, তাঁরাও কি সরকারি রোষেরই শিকার হলেন?

বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর, আগামী সোমবার, ১ জুন ওই দুই শিক্ষককে নতুন জায়গায় যোগ দিতে বলা হয়েছে। অনীকবাবুর যাওয়ার কথা মঙ্গলকোট কলেজে। দেবপ্রিয়বাবুকে পাঠানো হয়েছে রানিবাঁধ কলেজে। দু’টি কলেজই এই শিক্ষাবর্ষে যাত্রা শুরু করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকের আশঙ্কা, বদলির সংখ্যা বাড়তে থাকলে প্রেসিডেন্সির পঠনপাঠন ব্যবস্থা কার্যত মুখ থুবড়ে পড়বে।

শিক্ষা শিবিরের অনেকের আশঙ্কা শুধু শিক্ষকের অভাবের জন্য নয়, অভিজ্ঞ শিক্ষকের ঘাটতির জন্যও। তাঁদের বক্তব্য, প্রেসিডেন্সিতে এখন যে-সব শিক্ষক আছেন, তাঁদের বেশির ভাগই তরুণ। অভিজ্ঞ প্রবীণেরা সংখ্যায় খুবই কম। তাই একসঙ্গে দু’-দু’জন অভিজ্ঞ বিভাগীয় প্রধানকে বদলি করায় প্রতিষ্ঠানের পঠনপাঠন বড় ধরনের ঘা খাবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE