ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন রূপা। সঙ্গে স্বামী ও মেয়ে।— নিজস্ব চিত্র।
রাতের কলকাতায় বাড়ি ফিরতে গিয়ে এমন অভিজ্ঞতা যে হতে পারে, সত্যিই ভাবিনি।
চার দিন আগে আমার মা সেরিব্রাল স্ট্রোকে কোমায় চলে গিয়েছেন। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ক্রমাগত দৌড়াদৌড়ি করছি। রবিবার দুপুর থেকে আমার বাবারও শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। ফলে পারিবারিক ও মানসিক ভাবে খুব বিপর্যস্ত আমরা সকলেই। রবিবার বিকেলে স্বামীর সঙ্গে বরাহনগর থেকে মুচিপাড়ায় দিদির বাড়িতে এসেছিলাম। সবাই মিলে হাসপাতালে মাকে দেখার পরে দিদির বাড়িতেই ফিরে আসি। প্রথমে ভেবেছিলাম, রাত হয়ে গিয়েছে, আর বাড়ি ফিরব না। পরে স্বামীর ব্যবসার কারণে সিদ্ধান্ত পাল্টাই। কিন্তু ফিরতে গিয়ে এ ভাবে নাকাল হব ভাবিনি।
রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ মুচিপাড়া থেকে রওনা দিই। আমার স্বামী দেবাশিস নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। পাশের সিটে ছিলাম আমি, পিছনের সিটে আমার চোদ্দো বছরের মেয়ে। হেদুয়ার মোড়ে আচমকা একটি মোটরবাইক ডান দিক থেকে আমাদের গাড়িতে ধাক্কা মারে। মেয়ে ছিটকে আসে আমার দিকে। আশপাশ থেকে চলে আসে আরএ বেশ কয়েক জন যুবক। আমার স্বামী গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বেরোতেই তাঁর উপরেই চড়াও হয় ওই যুবকেরা। এ দিকে, স্থানীয় লোকজনও জড়ো হয়ে যায়।
ইতিমধ্যে আমার জামাইবাবু কৃষ্ণেন্দু রায়কে খবর দিয়েছিলাম। তিনি মোটরবাইকে এক বন্ধুকে নিয়ে চলে এসে কোনও রকমে ওই যুবকদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি শান্ত করেন। পুলিশের একটা গাড়িও চলে আসে। স্থানীয় লোকজনই তখন আমাদের থানায় না যেতে অনুরোধ করেন। তাঁদের কথায় ওই যুবকেরাই কিছু টাকা চাঁদা তুলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমার স্বামীর হাতে ধরিয়ে দেয়।
ঘড়িতে তখন প্রায় রাত ১টা। আমরা তখন দিদির বাড়িতেই ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ইতিমধ্যে কয়েকটি বাইকে বেশ কয়েক জন আমাদের পিছু নিয়েছে। এ দিকে, আমার জামাইবাবুও সামনে বাইকে এগোচ্ছিলেন। কলেজ স্ট্রিট মোড়ের কাছে ওঁর বাইক কিছুটা এগিয়ে যায়। কলেজ স্ট্রিটে ডাবপট্টির কাছে বর্ণপরিচয়ের দোকানের সামনে বাইক-আরোহী ওই যুবকেরা ফের আমাদের উপরে হামলা করে।
দু’টি মোটরবাইক নিয়ে এগিয়ে এসে ওরা আমাদের গাড়ির পথ আটকে দাঁড়ায়। তার পরে আমার স্বামীর কলার খামচে ধরে টেনে বার করার চেষ্টা করে। আমার স্বামীও ওদের পরোয়া না করে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসেন। তর্কাতর্কি ও হাতাহাতি হওয়ারও উপক্রম হয়। এর পরেই ওরা আমাকে আর আমার মেয়েকে আক্রমণের চেষ্টা করে। আমার গলা থেকে হারটা টেনে খুলে নিতে চায়। কোনও রকমে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিই। তখনই গাড়ি থেকে টেনে বার করার চেষ্টা করে আমার মেয়েকেও। ভয়ে বুক কেঁপে উঠেছিল। মেয়েও তখন ভয়ে চিৎকার করছে, ‘মা বাঁচাও, মা বাঁচাও’। রাস্তায় তখন একটা লোকও নেই, যে সাহায্যের জন্য ডাকব। আমি পিছন দিকে ঘুরে গাড়ির দরজাটা টেনে ধরে রাখার চেষ্টা করি। ওরা গাড়িতে লাথি মারতে থাকে। সঙ্গে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি। গণ্ডগোল হচ্ছে দেখে ততক্ষণে সামনে থেকে বাইক ঘুরিয়ে চলে এসেছিলেন আমার জামাইবাবু। ওরা আটকে দেওয়ায় এগোতে পারেননি। পরে জেনেছি, রিভলভার চেপে ধরে ওঁকে আটকে রেখেছিল ওরা।
ইতিমধ্যে পুলিশের একটা গাড়ি টহল দিতে দিতে ঘটনাস্থলে হাজির। তা দেখেই ওরা সকলে পালাতে চেষ্টা করে। এর মধ্যে ট্রামলাইনে একটি মোটরবাইক পিছলে পড়ে যায়। আরোহী তিন যুবকও ছিটকে পড়ে মাটিতে। পুলিশ ওদের ধরে থানায় নিয়ে যায়। পরে আমার স্বামীর অভিযোগের ভিত্তিতে ওদের গ্রেফতার করে পুলিশ। আমরা এর পরে কোনও রকমে দিদির বাড়ি ফিরে আসি। সারা রাত আর কেউ ঘুমোতে পারিনি।
আমার প্রশ্ন একটাই। কেন রাতে আমরা সাধারণ মানুষ রাস্তায় নিরাপদে বেরোতে পারব না? রাতের শহরে মোটরবাইকের এই উদ্দাম বেলেল্লাপনা রুখতে কেন কড়া কোনও ব্যবস্থা নেবে না পুলিশ-প্রশাসন? দিনের পর দিন একের পর এক ঘটনা মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া কি আর কোনও উপায় নেই? উত্তরগুলো কিন্তু আমরা সকলেই জানতে চাই।
ধৃতদের পুলিশ হেফাজত। কলেজ স্ট্রিটের এই ঘটনায় রূপাদেবীর স্বামী দেবাশিস পালচৌধুরীর অভিযোগের ভিত্তিতে ধরা পড়ে তিন যুবক। ধৃত মহম্মদ নাদিম, মহম্মদ আলি আকবর এবং মহম্মদ ইশাক সকলেই এন্টালির ছাতুবাবু লেনের বাসিন্দা। বাজেয়াপ্ত হয় তাদের মোটরবাইকটিও। ধৃতদের বিরুদ্ধে ভয় দেখানো, ছিনতাই ও অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের করে তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। সোমবার ব্যাঙ্কশাল আদালত ধৃতদের ৪ মে পর্যন্ত পুলিশ হেফাজত দিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy