Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
ঘাতক লরি /২

নতুন চাকরির প্রথম রাতেই প্রাণ গেল তরুণীর

শেষ হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে লিখেছিলেন, ‘নাইট লাইফ ইজ অসাম! নৈশজীবন দারুণ লাগছে।’ প্রিয় সেই রাতের শহরই দাঁড়ি টেনে দিল তাঁর জীবনে। এক মাসে আগে প্রথম চাকরিতে পা। প্রায় কাকুতিমিনতি করেই কর্তৃপক্ষের কাছে চেয়ে নিয়েছিলেন রাতের ডিউটি। যাতে একটু বেশি রাতে শিফ্‌ট শেষ হওয়ার পরে মাঝরাতের কলকাতার আলো ঝলমলে পথ ধরে বাড়ি যাওয়া যায়।

সায়নী মুখোপাধ্যায়

সায়নী মুখোপাধ্যায়

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৬ ০১:২৯
Share: Save:

শেষ হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে লিখেছিলেন, ‘নাইট লাইফ ইজ অসাম! নৈশজীবন দারুণ লাগছে।’

প্রিয় সেই রাতের শহরই দাঁড়ি টেনে দিল তাঁর জীবনে।

এক মাসে আগে প্রথম চাকরিতে পা। প্রায় কাকুতিমিনতি করেই কর্তৃপক্ষের কাছে চেয়ে নিয়েছিলেন রাতের ডিউটি। যাতে একটু বেশি রাতে শিফ্‌ট শেষ হওয়ার পরে মাঝরাতের কলকাতার আলো ঝলমলে পথ ধরে বাড়ি যাওয়া যায়। কিন্তু সোমবার, সেই শিফ্‌টের প্রথম রাতেই আর বাড়ি ফেরা হল না সায়নী মুখোপাধ্যায়ের (২২)। সায়নীর অফিসের গাড়িকে পিষে দিয়ে চলে গেল বেপরোয়া ট্রাক।

পুলিশ জানায়, সোমবার রাত পৌনে ১২টা নাগাদ দুর্ঘটনাটি ঘটে অরবিন্দ সরণি ও রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটের সংযোগস্থলে, গৌরীবাড়ি মোড়ে। সেপ্টেম্বরেও ওই একই জায়গায় একটি বাসের সঙ্গে অটোর ধাক্কায় প্রাণ হারান জয়পুরিয়া কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী পূজা পাল। ফের সেখানেই এই দুর্ঘটনার পরে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, জায়গাটি দুর্ঘটনাপ্রবণ হওয়া সত্ত্বেও বেশি রাতে ওই মোড়ে কখনও পুলিশ থাকে না।

লালবাজারের একটি সূত্রের খবর, শীঘ্রই ওই মোড়ে স্পিড-ব্রেকার বসানো হবে। তবে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত ঘাতক ট্রাক বা তার চালককে পুলিশ ধরতে পারেনি। পুলিশ জানায়, সিসিটিভির ফুটেজ দেখে ঘাতক ট্রাকটিকে ধরার চেষ্টা হচ্ছে।

পুলিশ জানায়, সায়নীর বাড়ি বাগবাজারের হরলাল মিত্র স্ট্রিটে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর সল্টলেকের এক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় চাকরি পেয়েছিলেন তিনি। প্রায় এক মাস তাঁর ডিউটি ছিল সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টার শিফ্‌টে। ওই তরুণীর ছোটবেলার বন্ধু শুভশ্রী শেঠ বলেন, ‘‘সায়নী চাইত রাত পর্যন্ত কাজ করতে, রাত করে বাড়ি ফিরতে। তাই, সংস্থার কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে দুপুর ১টা থেকে রাত ১১টার শিফ্‌টে ডিউটি চেয়ে নিয়েছিল। সোমবারই ছিল ওই শিফ্‌টে ডিউটির প্রথম দিন।’’

দুর্ঘটনার মিনিট পনেরো আগে শুভশ্রীকেই হোয়াটসঅ্যাপ করেছিলেন সায়নী। তার পরে বন্ধুর এই পরিণতি এখনও মেনে নিতে পারছেন না শুভশ্রী। মঙ্গলবার দুপুরে তিনি বলেন, ‘‘আমাকে ও জানাল, রাতের জীবন দুর্দান্ত লাগছে। তার পরে রাতে আর কথা হয়নি। সকালে শুনলাম, সায়নী নেই। বিশ্বাসই করতে পারছি না।’’

ঠিক কী ভাবে ঘটল দুর্ঘটনা?

পুলিশ জানায়, সোমবার রাতে সল্টলেকের ওই সংস্থার গাড়িতেই ফিরছিলেন সায়নী। রাত পৌনে ১২টা নাগাদ উল্টোডাঙার দিক থেকে অরবিন্দ সেতু পেরিয়ে খন্না সিনেমার দিকে যাচ্ছিল গাড়িটি। সিগন্যাল সবুজ থাকায় গৌরীবাড়ি মোড় পেরিয়ে গাড়িটি এগোতেই মানিকতলার দিক থেকে সজোরে ধেয়ে আসা একটি ট্রাক সরাসরি ধাক্কা মারে পিছনের দরজায়। লাগোয়া সিটেই ছিলেন সায়নী। ট্রাকের ধাক্কায় গাড়িটি দুমড়ে, উল্টে, ছিটকে অন্য প্রান্তের ফুটপাথের দিকে কোনাকুনি গিয়ে পড়ে। সেই ধাক্কায় ফুটপাথের রেলিং পর্যন্ত ভেঙে পড়ে।

ঘটনাস্থলের উল্টো দিকের ওই ফুটপাথেই খাবারের দোকান দশরথ সাউয়ের। তাঁর কথায়, ‘‘বিকট আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। দেখি, ফুটপাথের দিকে হুড়মুড়িয়ে উল্টেপাল্টে কিছু একটা ধেয়ে আসছে। পড়িমরি করে উঠে পড়ি। সম্বিৎ ফিরতে দেখলাম, আস্ত একটা গাড়ি! ভিতর থেকে প্রবল আর্তনাদ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটি ট্রাক গতি বাড়িয়ে চলে যায় শ্যামবাজারের দিকে।’’

দোমড়ানো-মোচড়ানো গাড়িটি তখন উল্টে রয়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাস্তা। ভিতরে আটকে ছিলেন সায়নী ও তাঁর সহকর্মী স্নেহা সাউ, অফিসের এক নিরাপত্তারক্ষী এবং গাড়িচালক। কোনও ভাবেই তাঁদের বার করা আনা যাচ্ছিল না। পুলিশ পৌঁছে গাড়ির অন্য দিকের দরজা কেটে, ভেঙে তাঁদের উদ্ধার করে। সকলকেই নিয়ে যাওয়া হয় আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। প্রাথমিক চিকিৎসার পরে বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হলেও সায়নীর অবস্থার ক্রমশ অবনতি হতে থাকে। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানেই রাত আড়াইটে নাগাদ মারা যান ওই তরুণী।

মঙ্গলবার দুপুরে বাগবাজারে সায়নীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ভিড় করে রয়েছেন তাঁর বন্ধুরা। এ বছরই স্নাতক হয়ে চাকরি পেয়েছিলেন ওই তরুণী। তাঁর ছোট বোন সৌমিতা বলেন, ‘‘রাত ১১টা নাগাদ মা দিদিকে ফোন করে বলেছিল, ‘সাবধানে আসিস।’ দিদি বলেছিল, ‘গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি। এখনই দিয়ে দিবে। আমি আসছি, চিন্তা কোরো না। তার পরেই কী যে হয়ে গেল!’’

‘‘দিদি এত বকবক করত যে সব সময়ে বলতাম, তুই এ বার একটু থাম। এক বারও কি ভেবেছিলাম, চিরদিনের জন্য দিদি থেমে যাবে!’’ বলতে বলতে গলা বুজে আসে বোনের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Woman dies Car Accident Sayani Mukhopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE