Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ইতিহাস আছে, উদ্যোগ নেই পর্যটন প্রসারে

রাজা আজ আর নেই। আড়াইশো বছরের প্রাচীন রাজবাড়িটা দেখলে মনে হবে এই সে দিনের। সন্ধ্যায় রাজবাড়ির চারটি চত্বর ঢেকে যায় অদ্ভুত এক আলোয়। সেই আলো প্রতিবিম্বিত হয় বড় দিঘির জলে। ঠাকুর দালানের চৌহদ্দি পেরিয়ে বড় উঠোনটাও পর পর আলোকবাতিতে সাজানো। সেই বাতিদানের উপর শেষ বিকেলের আলো দেখে পর্যটক আপ্লুত হন। ঠাকুরদালানে বেজে ওঠে শাঁখ। শীত মরসুমে তো বটেই, বছরের অন্য সময়েও পাণ্ডুয়ার এই ইটাচুনা রাজবাড়ি দেখতে ভিড় জমান পর্যটক।

ইটাচুনা রাজবাড়ির  প্রধান ফটক।

ইটাচুনা রাজবাড়ির প্রধান ফটক।

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
পাণ্ডুয়া শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৪ ০১:২৬
Share: Save:

রাজা আজ আর নেই। আড়াইশো বছরের প্রাচীন রাজবাড়িটা দেখলে মনে হবে এই সে দিনের।

সন্ধ্যায় রাজবাড়ির চারটি চত্বর ঢেকে যায় অদ্ভুত এক আলোয়। সেই আলো প্রতিবিম্বিত হয় বড় দিঘির জলে। ঠাকুর দালানের চৌহদ্দি পেরিয়ে বড় উঠোনটাও পর পর আলোকবাতিতে সাজানো। সেই বাতিদানের উপর শেষ বিকেলের আলো দেখে পর্যটক আপ্লুত হন। ঠাকুরদালানে বেজে ওঠে শাঁখ।

শীত মরসুমে তো বটেই, বছরের অন্য সময়েও পাণ্ডুয়ার এই ইটাচুনা রাজবাড়ি দেখতে ভিড় জমান পর্যটক। তার মধ্যে থাকেন ভিন্‌ দেশিরাও। কিন্তু শহরে থাকার জায়গা সে ভাবে গড়ে উঠল না। এ নিয়ে শহরবাসীর আক্ষেপের শেষ নেই। জেলা প্রশাসনও এ ব্যাপারে কোনও আশার আলো এখনও দেখাতে পারেননি।

পাণ্ডুয়া শহর থেকে হাত বাড়ালেই ইটাচুনা রাজবাড়ি। শের শাহের তৈরি গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড পিছনে ফেলে খন্যানের লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে পাকা রাস্তা বরাবর সোজা এগিয়ে গেলে সঙ্গী হবে ধানখেত। বুক চিরে চলে গিয়েছে রেললাইন। অল্প কয়েক কিলোমিটার পাকা রাস্তা পেরিয়েই ডান হাতে রাজবাড়ি। গেট দিয়ে ঢুকে নাটমন্দির। বিশাল দালান। উপরে ঝাড়বাতি। ডান দিকে সিঁড়ি। প্রথম ঘরটাই সংগ্রহশালা। পুরনো আমলের একে-৪৭ থেকে রিভলভার, চাবুক, নানা মাপের তরোয়াল সুন্দর ভাবে সাজানো। দেওয়ালে ঝুলছে পুরনো কলকাতা ও পাণ্ডুয়ার ছবি। টেলিফোন, বাসনপত্র, বাদ্যযন্ত্র, মাছ ধরার ছিপ, আরও কত কী! বারান্দায় জলচৌকির উপরে দাবার বোর্ড দেখে অনেকেই থমকান। সোজা এগোলে দরবার হল। দু’পাশে হাতে টানা পাখা এখনও ঝুলছে। আছে জলচৌকির উপরে দাবা বোর্ডও। নানা মহলে নানা সম্ভার। প্রতি সন্ধ্যায় ঠাকুরদালানে আরতি দেখতে গ্রামবাসীরা ভিড় জমান।

এখানেই বসত দরবার।

রাজ পরিবারের সংগ্রহশালা।

রাজবাড়ির কিউরেটর কল্যাণকুমার যশ জানান, আড়াইশো বছর আগে সাফল্যরাম কুণ্ডুর জমিদারির সময়েই এই বাড়ি তৈরি হয়। অন্দরমহলে ঢুকে খোদ রাজ পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম ধ্রবনারায়ণ কুণ্ডুর মুুখে রাজকাহিনি শোনার স্বাদই আলাদা। কলকাতার খুব কাছে ছুটি কাটানোর এমন আয়োজন এখনও অনেকেরই অজানা। সাধ্যের মধ্যে খরচে শুধু রাজবাড়িতে নয়, চাইলে সেই আমলের আসবাব দিয়ে সাজানো ঘরে থাকার আমেজও পেতে পারেন পর্যটকেরা। ব্যবস্থা করেছেন রাজবাড়ি কর্তৃপক্ষই। পর্যটকদের জন্য এ বার শীতে আরও ব্যবস্থার পরিকল্পনা করেছেন তাঁরা। ধ্রুবনারায়ণবাবু বলেন, “শীত আসছে। পর্যটনের কথা মাথায় রেখে গাড়িতে করে বাইশ দরওয়াজা, সিমলাগড় কালীবাড়ি ঘোরানারও পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।”

জেলা সদর চুঁচুড়া থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে গ্রাম ঘেঁষা এই জনপদে অবশ্য শুধু রাজবাড়িই নয়, ইতিউতি ছড়িয়ে রয়েছে নানা টুকরো ইতিহাস। ট্রেনে এসে শহরে ঢোকার মুখেই প্রায় শাহ সুফি সুলতানের সমাধিক্ষেত্র স্থানীয় ভাবে ‘বাইশ-দরওয়াজা’ নামেই পরিচিত। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের দেওয়া তথ্যে ৭০.৪ মিটার লম্বা এবং ১২.৮০ মিটার চওড়া এই ইমারতে তিনটি বারান্দা সমেত ২৪ দরওয়াজা (দরজা) রয়েছে। ৬৩টি নকশাযুক্ত গম্বুজ রয়েছে। ইটের তৈরি খিলান আর ছাতার আকারে বেদি এই স্থানটির বিশেষ আকর্ষণ। তার গা-ঘেঁষেই আর আকাশছোঁওয়া প্রাচীন স্মারক। এখনকার ধ্বংসাবশেষ দেখলেই বোঝা যায়, ছোট ছোট ইটের তৈরি বাইশ দরওয়াজা যখন অক্ষত ছিল, তখন তার রূপ ছিল চোখ ধাঁধানো। এক একরের বেশি জমির উপর অবস্থিত এই অঞ্চলটি কেন্দ্রীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধিগৃহীত।

জিটি রোডের ধারে মিনার।

অন্দরমহলে এখানেই বসত দাবার আসর।

নাটমন্দিরের আদলে এখানে এখনও উঁচু মঞ্চ রয়েছে। ভগ্নস্তূপের থামের পাথর জানান দেয় প্রাচীনত্ব। কয়েকশো বছরের প্রাচীন মেলা বসে এর প্রাঙ্গণে। সরকারি স্তরে আজও এই ঐতিহাসিক মেলার আয়োজন হয়ে আসছে। স্থানীয় বাসিন্দা শেখ আহমেদ বলেন, “এক সময়ে বছরে তিনটি মেলা হত। এখন অবশ্য সেই মেলা একটায় ঠেকেছে। এক সময় জুয়া খুব বিখ্যাত ছিল। জুয়ার বোর্ডে লক্ষ লক্ষ টাকা ওড়াতেন বড়লোকেরা।”

শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে জিটি রোডের ধারের সিমলাগড় কালী বাড়ি দেখতেও ভিড় জমান পর্যটকেরা। সেবাইত দেবব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “শের শাহের আমল থেকেই এই মন্দির ডাকাতে-কালী বা দক্ষিণা কালী মন্দির হিসেবে পরিচিত। কথিত আছে, ডাকাতেরা ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে এখানে পুজো দিয়ে যেত। নানা গল্পের মধ্যেই এই মন্দিরের মাহাত্ম্য লুকিয়ে রয়েছে।”

এ শহরে মূলত দিনের বেলাতেই ঘুরতে আসেন পর্যটকেরা। আসেন কলকাতার শিল্প-সাহিত্য মহলের প্রথিতযশারাও। এক সময়ে প্রায়ই আসতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও। শহরবাসী চান, ইতিহাসের আস্বাদ নিতে আরও পর্যটক আসুক। চাই শুধু থাকার জায়গা।

ছবিগুলি তাপস ঘোষের তোলা।
(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE