শহরের প্রাণকেন্দ্রে অপরিকল্পিত ভাবে তৈরি করা হয়েছে বাস স্ট্যান্ড।
দিন কয়েক আগের এক রাত। ঘড়িতে তখন ৯টা ১৫। তাপমাত্রা বেশ নীচের দিকে। ডোমজুড় বাজারে উদ্বিগ্ন মুখে পায়চারি করছেন এক দম্পতি। বেশির ভাগ দোকানে ঝাঁপ পড়তে শুরু করেছে। কালীঘাটের ওই দম্পতি ডোমজুড়ের বন্দরপাড়ায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে এসেছিলেন। বাসস্ট্যান্ডে এসে শুনছেন কলকাতা ও হাওড়াগামী শেষ বেসরকারি বাস চলে গিয়েছে। রাত ১০টা ১৫ মিনিটে একটি সরকারি বাস হাওড়া যায় বটে তবে সেটি অনিয়মিত। শীতের রাতে ফেরা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন দম্পতি।
এই ডোমজুড় বাজারেই আবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ছবিটা একেবারে উল্টো। তখন বাস, অটো, ট্রেকার ও ছোট গাড়ির চাপে শহরের দমবন্ধ হয়ে আসে। শহরের উপর দিয়ে যাওয়া হাওড়া-আমতা রোড অন্যতম ব্যস্ত রাস্তা। দিন দিন গাড়ির সংখ্যা বাড়লেও ডোমজুড় এলাকায় এই রাস্তা বাড়েনি বললেই চলে। অথচ, রাস্তার দু’পাশেই রয়েছে হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক, স্কুল, কলেজ ও সরকারি অফিস। ডোমজুড় বাজারের মধ্যেই বাস স্ট্যান্ড তৈরি হওয়ায় যানজট এখানকার নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশ ও সিভিক ভলান্টিয়াররা যান নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও লাভ হয় না। দু’মিনিটের রাস্তা পেরোতে ৩০ মিনিট লেগে যায়। এই দুর্ভোগ থেকে কবে মুক্তি মিলবে, তা নিয়ে ভাবনার অন্ত নেই।
প্রশাসনিক কাঠামোয় এই জনপদ পঞ্চায়েত স্তরে থাকলেও বাস্তবে একে শহরই বলা চলে। সরকারি স্তরে একে পুরসভা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। স্টেডিয়াম থেকে বাসস্ট্যান্ড, বহুতল থেকে নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুল--সবই রয়েছে। তবু অফিসের সময়ে নিত্য যানজট আর রাত নামলে বাস না মেলার দুশ্চিন্তাই কলকাতা থেকে ২০ কিমি দূরের এই জনপদকে এখনও কিছুটা হলেও পিছনে টেনে রেখেছে।
তার জেরে নিত্য যানজট বাজার এলাকায়। ছবি: রমাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়।
অথচ, এক সময়ে এই জনপদের পরিবহণ ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ ছিল। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এখানে চলত ছোট রেল (মার্টিন রেল)। সত্তরের দশকের শুরুতে সেই রেল চলাচল বন্ধ হয়ে শুরু হয় বাস পরিসেবা। শহরের প্রবীণরা জানান ষাটের দশকে ডোমজুড় থেকে কদমতলা পাওয়ার হাউস পর্যন্ত কিছু ছোট বাস চলত। সেখানে নেমে ফের বাস পাল্টে হাওড়া যেতে হত। মার্টিন রেল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ১৯৭০-৭১ সাল নাগাদ চালু হয় ৬৩ নম্বর রুট। ওই রুটের প্রবীণ বাসকর্মী বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায় ও বাস-মালিক লালমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, প্রথমে এই বাস হাওড়া থেকে ডোমজুড় হয়ে কোনওটি যেত আমতা, কোনওটি মুন্সিরহাট, কোনওটি উদয়নারায়ণপুর। পরে রুট সংক্ষিপ্ত হয়ে হয় হাওড়া থেকে ডোমজুড়। যাত্রী চাপ বাড়ায় এর পর চালু হয় ১৬ নম্বর রুটের মিনিবাস। নব্বইয়ের দশকের মাঝে চালু হয় ডোমজুড়-ধর্মতলা ও হাওড়া-মুন্সিরহাট (ভায়া ডোমজুড়) সরকারি সিটিসি বাস। বর্তমানে রুটগুলি তো আছেই, এর সঙ্গেই সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে দু’টি নতুন রুট। একটি কে-১১ (ডোমজুড়-ধর্মতলা) ও বড়গাছিয়া-শিয়ালদহ (ভায়া ডোমজুড়)। ফলে, হাওড়া ও কলকাতা এখন ডোমজুড়বাসীর হাতের কাছে। তবে, সেটা রাত ৮টা পর্যন্ত। কারণ, তার পর থেকে সব রুটেই বাস কমতে থাকে। আশির দশকের শেষ দিকে হাওড়া-আমতা রেলপথ তৈরি হয়। ডোমজুড়ে গড়ে ওঠে স্টেশন। তবে, ট্রেনের সংখ্যা কম হওয়ায় এই জনপদের বেশির ভাগ মানুষ এখনও বাস পরিষেবার উপরেই নির্ভরশীল।
বাজার এলাকায় মার্টিন রেল। সংগৃহীত ছবি।
কিন্তু যে সড়ক পরিবহণের উপরে মানুষ নির্ভরশীল, তা-ই স্তব্ধ হয়ে যায় যানজটে। স্থানীয় বাসিন্দার অভিযোগ, অপরিকল্পিত ভাবে বাসস্ট্যান্ড তৈরি ও চালকদের ইচ্ছেমতো বাস চালানোর জন্যই তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে গোটা শহরে। বাসস্ট্যান্ডের পাশেই রয়েছে ট্রেকার, অটো, রিকশা স্ট্যান্ড। শহর থেকে আন্দুল, বন্যাপাড়া, বেগরি, খাঁটোরা, ধুলাগড়ি, সিদ্ধেশ্বরের মতো ভিতরের দিকে যেতে গেলে এই সব ছোট যানই ভরসা। রাত নামলে এই বিকল্প যান অদৃশ্য হতে শুরু করে।
বিষয়টি স্বীকার করেছে তৃণমূল পরিচালিত ডোমজুড় পঞ্চায়েত সমিতি। পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি বর্ণালি ঘোষ বলেন, ‘‘শহর প্রাণকেন্দ্রে বাস স্ট্যান্ড তৈরির পরিকল্পনা ভুল। স্ট্যান্ড তৈরি করেছিল বাম পরিচালিত পূর্বতন জেলা পরিষদ। আমরা বিকল্প জায়গায় বাসস্ট্যান্ড সরানোর চিন্তাভাবনা শুরু করেছি। জমি দেখার কাজ চলছে।’’
বাসিন্দাদের অনেকেই কিন্তু মনে করছেন শুধু বাসস্ট্যান্ড সরালে শহরের গতি ফিরবে না। তাঁদের মতে, হয় উড়ালপুল তৈরি হোক, অথবা বিকল্প বাইপাস রাস্তার চিন্তাভাবনা হোক। এ ছাড়া শহরের ভিতরে পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতি প্রয়োজন। ডোমজুড়ের বিডিও তমোঘ্ন কর, ডোমজুড় থানার আইসি মধূসূদন মুখোপাধ্যায় অবশ্য মানুষের সচেনতার অভাবকে যানজটের প্রধান কারণ মনে করেন। তাঁদের কথায়, ‘‘শহরে যানজট মূলত হয় থানার সামনে থেকে জেলেপাড়া অবধি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে যান নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। সাধারণ মানুষকেও বুঝতে হবে যে রাস্তার পাশে বেশিক্ষণ মোটর বাইক বা গাড়ি দাঁড় করালে যানজট বাড়বে। এই সচেতনতাটুকু তৈরি না হলে রাস্তা বাড়ালেও সমস্যা মেটা মুশকিল।’’ তবে বেশি রাতে যাতে হাওড়া ও কলকাতাগামী বাস পাওয়া যায়, সেই বিষয়টি তাঁরা গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন বলে জানান। সেই ভরসাতে সামনের দিকে এগোতে চায় ভবিষ্যতের পুর শহর।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy