ফ্রেঞ্চ ইনস্টিটিউট
শুধু কলকাতার জানবাজার নয়, রানি রাসমণির বাড়ি ছিল এ শহরেও।
জোয়ান অব আর্ক-এর মূর্তিটা এখনও লোকের চোখ টানে।
এ শহরের এক সময়ের ফরাসি গভর্নর জেনারেল দ্যুপ্লে নিজের ঘরে সিঁড়ি বেয়ে খাটে উঠতেন। সেই সিঁড়ি এবং খাট এখনও রয়েছে।
এক সময়ে স্বাধীনতা-বিপ্লবীদের নিশ্চিত আশ্রয়ও দিয়েছে এ শহর।
আড়ে-বহরে প্রতিদিনই পাল্টাচ্ছে গঙ্গাপাড়ের চন্দননগর। তৈরি হচ্ছে উড়ালপুল। বাড়ছে নামী ব্র্যান্ডের দোকান। মাথা তুলছে বহুতল। রাস্তায় দামি গাড়ির ভিড়। তবু, ইতিহাসকে এ শহর এখনও ভোলেনি। এক সময়ের এই ফরাসি উপনিবেশের স্থাপত্য, সৌন্দর্য, রুচি, শিক্ষা, সংস্কৃতি নিয়ে এ শহরের বাসিন্দারা গর্বিত। তাঁরা শুধু চান, গর্বের শহরের ইতিহাসকে যত্নে লালন করা হোক। টিকিয়ে রাখা হোক শহরের বৈশিষ্ট্য।
কলকাতার দিক থেকে জি টি রোড হয়ে যাঁরা চন্দননগরে যান, তাঁদের শহরে ঢোকার মুখে পেরোতে হয় ‘চন্দননগর গেট’। যা তৈরি হয়েছিল ফরাসি আমলে। অন্তত ২০০ বছরের পুরনো এই সৌধে সেই আমলের সাক্ষ্যবাহী নানা তথ্য সংবলিত ফলক এখনও রয়েছে। শহরের অন্য প্রান্তে, চুঁচুড়ার দিকে তালডাঙা মোড়েও এমনই ‘গেট’ বানিয়েছিলেন ফরাসিরা। কিন্তু যান চলাচলের সুবিধার জন্য সেই গেট পরে ফরাসি শাসকেরাই সরিয়ে দেন।
জোড়াঘাট
চন্দননগর হাসপাতালেও রয়েছে সেই আমলের নানা স্মারক। বস্তুত, হাসপাতালের একাংশ ফরাসি আমলেই তৈরি। পরে হাসপাতাল বহরে বিস্তার লাভ করলেও আজও রয়ে গিয়েছে পুরনো অংশটি। তবে, সেখানে বয়সের ছাপ পড়েছে। প্রবীণেরা বলছেন, হাসপাতালের ওই অংশটির সঙ্গে শুধু ফরাসি আমলের নয়, রাণি রাসমণির স্মৃতিও জড়িয়ে রয়েছে। হাসপাতাল ভবনটির মালিক এক সময়ে ছিলেন জানবাজারের রানি।
শহরের সবচেয়ে সুন্দর এলাকাটি যে স্ট্র্যান্ড, সেটা শুধু শহরবাসী নন, বহিরাগতরাও স্বীকার করেন। গঙ্গার ধারের গাছে ছাওয়া রাস্তার এক ধারে ফ্রেঞ্চ ইনস্টিটিউট (মিউজিয়াম), অল্প দূরে গির্জা, মহকুমা আদালত, থানা, কলেজ, সংশোধনাগার সব পর পর দাঁড়িয়ে। রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ও বিদ্যাসাগরের স্মৃতিধন্য ‘পাতালবাড়ি’ও। জি টি রোডের ধারের ‘নিত্যগোপাল স্মৃতি মন্দির’ বহন করছে ফরাসি স্থাপত্যের নিদর্শন।
ফ্রেঞ্চ ইনস্টিটিউটে এখনও নিয়মিত ফরাসি ভাষা শিক্ষার ক্লাস চলে। মিউজিয়ামে ঢোকার মুখেই চোখে পড়ে ‘জোয়ান অব আর্ক’-এর মূর্তি। ভিতরে দ্যুপ্লের খাট-বিছানা-সিঁড়ি। রয়েছে গর্ভনরের ব্যবহার করা আয়না, চেয়ার, টেবিল। আর রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। এ শহরে এক সময় ফরাসিরা লালদিঘির কাছে একটি দুর্গ তৈরি করেছিল। সেই দুর্গের একটি ম্যাপ রয়েছে এই মিউজিয়ামে। পলাশি-যুদ্ধের আগে, চন্দননগর দিয়ে গঙ্গার উপর যেতে গিয়ে লর্ড ক্লাইভ সেই দুর্গ ভেঙে দিয়ে যান।
নিত্যগোপাল স্মৃতিমন্দির
চন্দননগর থানা
এ শহরের প্রবীণেরা এখনও এ সব গল্পে মাতেন। দূর থেকে আসা আত্মীয়-বন্ধুদের শোনান। তাঁদের পরের বহু প্রজন্মও যাতে শহরের এই বৈশিষ্ট্য নিয়ে গর্ব করতে পারে, তাই তাঁরা চান, ঐতিহ্য সংরক্ষিত থাকুক। ইতিমধ্যে শহরের ১৪টি সাংস্কৃতিক সংস্থা একটি বৈঠকের পরে শহরের মেয়রের কাছে ‘হেরিটেজ কমিটি’ তৈরির প্রস্তাব রেখেছে। যাতে কমিটির তত্ত্বাবধানে অতীতে সাজানো যায়। ওই বৈঠকে হাজির ছিলেন, চন্দননগরের বাসিন্দা, পরিবেশ-বন্ধু বিশ্বজিত্ মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “শহরের অতীতের নানা স্মৃতি রয়েছে, যা হারিয়ে ফেলার নয়। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর বহু মনীষীই এ শহরে এসেছিলেন। তাঁদের স্মৃতিও রয়েছে। সেই সব স্মৃতিকেই আমাদের অতি যত্নে সংরক্ষণ করতে হবে নতুন প্রজন্মের জন্য।”
শহরের আর এক বাসিন্দা শুভ্রাংশু রায় বলেন, “সব শহরেরই একটি বৈশিষ্ট্য থাকে। এ শহর যেমন বিপ্লব-তীর্থ, তেমনই ফরাসি সংস্কৃতিরও ধারক-বাহক। সব বড় রাস্তা ও রেললাইন গঙ্গার সঙ্গে সমান্তরাল। তাই বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিয়ে শহরের ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা হোক।”
চন্দননগর পুরসভার একটি ‘হেরিটেজ কমিটি’ রয়েছে। কিন্তু সেই কমিটির কাজকর্ম নিয়ে অনেকেই সন্তুষ্ট নন। তা হলে কী ভাবে ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা যাবে? মেয়র রাম চক্রবর্তী স্বীকার করেছেন পুরসভার ‘হেরিটেজ কমিটি’র আইনগত কোনও ক্ষমতা নেই। ফলে, সরাসরি হেরিটেজ নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে তাঁদের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আর্থিক ক্ষমতাও কমিটির সীমিত। একই সঙ্গে মেয়রের দাবি, “পুরসভা তার সাধ্যমতো চন্দননগরের ইতিহাস রক্ষায় কাজ করছে। পুরসভার কাছে এখানকার হেরিটেজ সংক্রান্ত একটি তালিকাও রয়েছে। সেই তালিকা থেকে নানা তথ্য জানা সম্ভব।”
স্ট্র্যান্ডকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে সম্প্রতি ১ কোটি ১৯ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছে রাজ্য সরকার। সেই কাজ শীঘ্রই শুরু হবে। শহরবাসী খুশি। তাঁরা চান, শহরের বাকি ঐতিহ্যকেও সাজানো হোক।
ছবি: তাপস ঘোষ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy