Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
একই চিত্র দুই জেলায়

নম্বরের গণ্ডি না পেরিয়েও টেস্টে পাশ

কেউ অঙ্কে শূন্য পেয়েছে। কেউ ইংরেজিতে পাঁচ। ইতিহাসে দশের কম পেয়েছে এমন উদাহরণও ভুরি ভুরি। বছর ঘুরলেই মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক। সম্প্রতি শেষ হয়েছে এই দুই পরীক্ষার টেস্ট। গ্রামীণ হাওড়া এবং হুগলির বহু স্কুলেই পরীক্ষার খাতা দেখতে গিয়ে আঁতকে উঠেছেন পরীক্ষকেরা।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৫ ০১:৪৯
Share: Save:

কেউ অঙ্কে শূন্য পেয়েছে। কেউ ইংরেজিতে পাঁচ। ইতিহাসে দশের কম পেয়েছে এমন উদাহরণও ভুরি ভুরি।

বছর ঘুরলেই মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক। সম্প্রতি শেষ হয়েছে এই দুই পরীক্ষার টেস্ট। গ্রামীণ হাওড়া এবং হুগলির বহু স্কুলেই পরীক্ষার খাতা দেখতে গিয়ে আঁতকে উঠেছেন পরীক্ষকেরা। নম্বর বাড়িয়েও পাশ নম্বর দেওয়া যায়নি অনেককে! তবু অভিভাবকদের ডেকে ওই সব ছাত্রছাত্রীদের ফাইনালে বসার ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চূড়ান্ত পরীক্ষায় কী করে তারা উত্তীর্ণ হবে, তা নিয়ে চিন্তায় স্কুল কর্তৃপক্ষ। সবাইকে পাশ করিয়ে দেওয়া হলে টেস্ট পরীক্ষা নিয়ে কী লাভ, এমন প্রশ্নও উঠছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের অবশ্য দাবি, স্কুল পরিচালন সমিতির চাপ বা অভিভাবকদের অনুরোধে এমনটা করতে হয়েছে। দিন কয়েক আগে জিরাটের কবুরা উচ্চ বিদ্যালয়ে দ্বাদশ শ্রেণির টেস্ট পরীক্ষায় ১১ জনকে আটকে দেওয়ায় এক দল ছাত্র ও গ্রামবাসী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের রাতভর আটকে রাখে।

হাওড়ার বাগনান হাইস্কুলে এ বার মাধ্যমিকের টেস্টে ৪০১ জন পরীক্ষা দিয়েছিল। কাউকেই আটকানো হয়নি। স্কুল সূত্রে জানানো হয়েছে, এ বার মাধ্যমিক পরীক্ষা অনেকটা এগিয়ে এসেছে। ফলে, টেস্টও আগে করতে হয়েছে। তাই পড়ুয়ারা প্রস্তুতির সময় কম পেয়েছে। প্রধান শিক্ষক ভাস্কর আদক বলেন, ‘‘অঙ্ক আর ইংরেজিতে ছাত্রছাত্রীদের ভীতি বরাবরই বেশি। তা ছাড়া, টেস্টে বাংলা-ইংরেজিতেও ফল বেশ খারাপ।’’ বাগনান আদর্শ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ২৩১ জন ছাত্রী মাধ্যমিকের টেস্ট দিয়েছিল। অনেকেই কয়েকটি বিষয়ে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। কাউকেই অবশ্য আটকানো হয়নি। আমতা পীতাম্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগ এবং ইংরেজিতে অনেকে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এখানেও সবাইকেই মূল পরীক্ষায় বসার ছাড়পত্র দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

প্রায় একই ছবি হুগলিতেও। মাধ্যমিকের টেস্টে হুগলির পান্ডুয়ার জামগ্রাম জনার্দন ইনস্টিটিউশনে ৫৮ জনের মধ্যে সবাইকেই পাশ করানো হয়েছে। প্রধান শিক্ষক ইন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় জানান, কম নম্বর পাওয়া পড়ুয়াদের অভিভাবকদের ডেকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে যে, ভাল করে না পড়লে মাধ্যমিকে সমস্যা হবে। তাদের আলাদা করে কোচিং-ও করানো হচ্ছে। জাঙ্গিপা়ড়া ডিএন উচ্চ বিদ্যালয়, রাজবলহাট উচ্চ বিদ্যালয়েও কাউকে আটকানো হয়নি। ডিএন উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানান, স্কুলের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই সবাইকে পাশ করানো হয়েছে।

কেই এই অবস্থা?

শিক্ষকদের দাবি, বহু পড়ুয়া টেস্টকে গুরুত্ব দিতে চায় না। কারণ তারা জানে, যা হোক করে ন্যূনতম নম্বরটুকু তুলতে পারলেই মূল পরীক্ষায় বসা নিশ্চিত। তাই টেস্ট মিটলে পড়া শুরু করব, এই মানসিকতা রয়েছে অনেক পড়ুয়ার। জাঙ্গিপাড়া ব্লকের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কথায়, ‘‘টেস্ট পরীক্ষা যেন এলেবেলে হয়ে গিয়েছে। একে তো প্রশ্নপত্র আগের থেকে অনেক সহজ হয়েছে। তার উপর পরিচালন সমিতির চাপ রয়েছে। ছাত্রছাত্রীরাও বুঝে গিয়েছে, ফেল করবে না।’’ কোনও কোনও শিক্ষক রাজনৈতিক চাপের কথাও বলেছেন। যেমন, হরিপাল ব্লকের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানান, মাধ্যমিকের টেস্টে আটকে যাওয়া একটি মেয়েকে পাশ করানোর দাবিতে পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্যার স্বামী স্কুলে আসেন। নিজের রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে মেয়েটিকে পাশ করানোর আর্জি জানান। আরামবাগ মহকুমাতেও যোগ্যতামান অর্জন না করা সত্ত্বেও অভিভাবকদের চাপে প্রায় সবাইকেই চূড়ান্ত পরীক্ষায় বসার ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন স্কুলে। আরামবাগ বড়ডোঙ্গল রমানাথ ইনস্টিটিউশনে মাধ্যমিক টেস্ট দেয় ২৪২ জন ছাত্রছাত্রী। প্রাথমিক ভাবে স্কুল কর্তৃপক্ষ চারটি বিষয়ে ফেল করা ৩১ জনকে আটকে দিয়েছিলেন। পরে অভিভাবকদের মুচলেকায় ৪ জন বাদে সকলকেই পরীক্ষায় বসার ছাড়পত্র দেওয়া হয়। উচ্চ মাধ্যমিকের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। পুড়শুড়ার জঙ্গলপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিকে ২০৮ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২৩ জন অকৃতকার্য হলেও অভিভাবকদের দাবিতে সবাইকেই ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। এমন উদাহরণ আরও রয়েছে।

তবে, ব্যতিক্রমও রয়েছে। কিছু স্কুল খারাপ নম্বর পাওয়া পড়ুয়াদের আটকে দিয়েছে। ডোমজুড়ের নেহরু বালিকা বিদ্যালয়ে মাধ্যমিকের টেস্টে ২৩৪ জনের মধ্যে ১৯ জনকে আটকানো হয়েছে। প্রধান শিক্ষিকা অসীমা রায়ের আক্ষেপ, ‘‘কয়েকজন অঙ্কে শূন্য, ইংরেজিতে দশের কম পেয়েছে। তাদের কী ভাবে মাধ্যমিকে বসবার ছাড়পত্র দিই!’’ অসীমাদেবীর মতে, পাঠ্যবই না পড়ে নোট মুখস্থ করার ফলে এই সমস্যা হচ্ছে। সাজেশনের বাইরে প্রশ্ন এলেই পড়ুয়ারা লিখতে পারছে না। খসমরা হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষক কৌশিক চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘বিষয় না বুঝে শুধু মুখস্থ করে খাতায় উগরে দেওয়াটা রেওয়াজ হয়ে দাড়িয়েছে। বাংলা, ইতিহাসের মতো বিষয়েও অনেকেই একই গৃহশিক্ষকের নোট পরীক্ষার খাতায় লিখে আসছে। নতুনত্ব না থাকায় গড়ে নম্বর দিতে হচ্ছে।’’

ডোমজুড় ডিউক ইনস্টিটিউশনে উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগের ৫ জন পড়ুয়ার মূল পরীক্ষায় বসার ছাড়পত্র মেলেনি। শিয়াখালা বেণীমাধব উচ্চ বিদ্যালয় ১৯৯ জনের মধ্যে ৮ জনকে আটকে দিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE