Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

মন্দিরে যাওয়া-আসার রাস্তা চওড়া করা হোক, চান পুণ্যার্থীরা

শীত থেকে গ্রীষ্ম, বারোমাস তারকেশ্বরে মন্দিরের মঙ্গলারতির শব্দে ভর করে সন্ধ্যা নামে। কিন্তু আলোকিত মন্দিরের বাইরে, মন্দির আর রাজবাড়ি লাগোয়া দুধপুকুরের মূল ঘাটটা প্রায় অন্ধকার। দূরে পুকুরের ঠিক ওপারে কুয়াশায় মোড়া গুটিকয় ট্রাইডেন্টের মিয়ানো আলো। দোকানের ঝাঁপ করতে শুরু করেছেন দোকানিরা। দিনের আলোয় ভক্তেরা পুণ্য অর্জনে যে দুধপুকুরে ডুব দেন, সেই পুকুরই এখন কালো আঁধারে মিশমিশে।

দু’ধারে দোকানের চাপে সংকীর্ণ হয়েছে মন্দিরের পথ। ছবি: দীপঙ্কর দে।

দু’ধারে দোকানের চাপে সংকীর্ণ হয়েছে মন্দিরের পথ। ছবি: দীপঙ্কর দে।

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
তারকেশ্বর শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:৫৮
Share: Save:

শীত থেকে গ্রীষ্ম, বারোমাস তারকেশ্বরে মন্দিরের মঙ্গলারতির শব্দে ভর করে সন্ধ্যা নামে।

কিন্তু আলোকিত মন্দিরের বাইরে, মন্দির আর রাজবাড়ি লাগোয়া দুধপুকুরের মূল ঘাটটা প্রায় অন্ধকার। দূরে পুকুরের ঠিক ওপারে কুয়াশায় মোড়া গুটিকয় ট্রাইডেন্টের মিয়ানো আলো। দোকানের ঝাঁপ করতে শুরু করেছেন দোকানিরা। দিনের আলোয় ভক্তেরা পুণ্য অর্জনে যে দুধপুকুরে ডুব দেন, সেই পুকুরই এখন কালো আঁধারে মিশমিশে। বস্তুত গোটা মন্দির চত্বরই নিয়ম করে আলো-আাঁধারিতে ছেয়ে যায় সূর্য ডোবার পর। পুকুরের চারপাশ আর মন্দিরে পরিকল্পনা মাফিক কোনও আলোর ব্যবস্থাই নেই কর্তৃপক্ষের।

অথচ এমনটা হওয়ার কথা নয় বলেই দাবি স্থানীয় প্রবীণদের। শুধু আলো নয়, মন্দির আর তার চারপাশে সার্বিক সুষ্ঠু পরিকল্পনার কোনও চিহ্ন চোখে পড়ে না। শ্রাবণ আর চৈত্রে এখানে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। অথচ রাস্তা বলতে পুরসভার ঘিঞ্জি সরু রাস্তা। সেই রাস্তার দু’দিকেই আবার সার সার দোকানের পসরা। ভাতের হোটেল, আচার, পুজোর উপকরণ, ফাস্ট ফুড আরও কত কী? অজস্র দোকানদার আর রাস্তায় পেতে রাখা ডালায় হাঁটাই দায়।

রাজ্যের নানা মন্দিরকে ঘিরে নতুন করে পর্যটন প্যাকেজের পরিকল্পনা করছে রাজ্য সরকার। সারা ভারতেই শৈবতীর্থ হিসেবে তারকেশ্বর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি নাম। অথচ বাম বা বর্তমানে রাজ্য সরকারের আমলে তারকেশ্বর নিয়ে সেরকম পরিকল্পনা কোথায়? রাজ্যে নতন সরকার আসার পর স্থানীয় বিধায়ক রচপাল সিংহের এলাকা উন্নয়ন তহবিলের টাকায় একটা বিশাল তোরণ হয়েছে। পুকুুর পাড়কে ঘিরে কিছু আলোর খুঁটিও পড়ে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। যা কিছু উদ্যোগের ইতি সেখানেই। এক প্রবীণ বাসিন্দা বলেন, “দক্ষিণেশ্বরে গেলে মন ভরে যায়। সেখানে বিরাট পরিসর। আগাগোড়া মন্দিরকে কেন্দ্র করে চোখে পড়ে পরিকল্পনার ছাপ।”

নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার ব্যবস্থা দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে। ডালাওয়ালাদের জন্য রয়েছে পৃথক ব্যবস্থা। গাড়ির পার্কিং মূল চত্বরের বাইরে। সেখানে ভিড় পুণ্যার্থীদের কাছে আতঙ্ক তৈরি করে না। পাণ্ডার অভব্য ব্যবহার বা টাকা পয়সা হাতিয়ে নেওয়ার ধারাবাহিক কোনও অভিযোগও নেই। তারাপিঠেও সম্প্রতি মন্দির চত্বর থেকে দোকানপাট ওঠানোর কাজ শুরু হয়েছে।

“অথচ এখানে তা করা যায় না কেন বুঝি না।” মন্তব্য প্রবীণের।

সম্প্রতি বিশিষ্ট অভিনেত্রী এবং সাংসদ সন্ধ্যা রায় মন্দিরে পুজো দিতে এসেছিলেন। পুলিশ ও মন্দির কর্তৃপক্ষ সব জানতেন। কিন্তু তারপরেও প্রবল ভিড়ে বেসামাল পরিস্থিতিতে পড়েন অভিনেত্রী। পুলিশ চেষ্টা করেও তাঁকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হন। অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।

প্রশ্ন উঠেছে স্বনামধন্য অভিনেত্রীর নিরাপত্তা যখন বিঘ্নিত তখন সাধারণ মানুষের পরিস্থিতি কী? এ বছরই তারকেশ্বরে জল ঢালতে যাওয়ার পথে কামারকুণ্ডু রেল গেটের কাছে পদপিষ্ট হয়ে এক মহিলা পুণ্যার্থীর মৃত্যু হয়।

বছর কয়েক আগে দুধপুকুর সংস্কারের কাজ চলার সময় জলে ডুবে গিয়ে এক পুর্ণ্যার্থীর মৃত্যু হয়। কিন্তু সেই মৃত্যুও টনক নড়াতে পারেনি প্রশাসনের। সেই সময় অসামরিক প্রতিরক্ষা দফতরের ডুবুরি আনিয়ে তারকেশ্বরে রাখা হয়েছিল বিপদ ঠেকাতে। কিন্তু বর্তমানে সেই ব্যবস্থা আর জারি নেই। পুকুর পুরোপুরি অরক্ষিত বলে অবিযোগ উঠেছে।

না মন্দির চত্বরে না মন্দিরের পথে, পরিকল্পিতভাবে পুণ্যার্থীদের নিরাপত্তা আজ প্রশ্নের মুখে। তার উপর পুণ্যার্থীদের জন্য পুরসভা বা মন্দির কর্তৃপক্ষের পরিষেবার ব্যবস্থাও অপ্রতুল। বিশেষত মহিলাদের শৌচাগার, স্নানের পর পোষাক পরিবর্তন এবং সার্বিক নিরাপত্তা আজ নানা প্রশ্নের মুখে। শ্রাবণ মাসে মূলত শনি, রবি এবং সোমবার গড়ে কমবেশি পাঁচ লক্ষ মানুষ আসেন মন্দিরে। এই বিপুল পরিমাণ মানুষের নিরাপত্তার জন্য সার্বিক পরিকল্পনা জরুরি।

স্থানীয় মানুষের বক্তব্য, শুধু সরকার বা পুলিশ নয়, মন্দির চত্বরের নিরাপত্তার বিষয়ে মন্দির কর্তৃপক্ষ উদাসীন। চাই নিজস্ব নিরপত্তা কর্মী। নজরদারির জন্য পর্যাপ্ত সিসি টিভির ব্যবস্থা। কোনও খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে কেউ যদি মন্দিরে ঢুকতে যায় তাঁদের চিহ্নিত করার জন্য নিরাপত্তা গেট জরুরি। অথচ সে সব কিছুই নেই।

মন্দিরমুখী রাস্তা কোথাও মাত্র ছয় ফুট আবার কোথাও তার চেয়েও ছোট। সরু গলিতে গাদাগাদি করে সর্পিল আকারে ভিড় যখন মন্দিরমুখী হয় তখন ঝুঁকি থাকেই। মন্দিরের রাস্তা চওড়া করা দরকার।

মন্দির পরিচালন কমিটির অন্যতম মাখা হুগলির জেলাশাসক মনমীত নন্দা অবশ্য বলেন, “তারকেশ্বরে মন্দির চত্বরের নিরাপত্তা এবং পুণ্যার্থীদের পরিষেবা সংক্রান্ত বিষয়গুলি নিশ্চিত করতে সার্বিক পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে শুধু খাতায় কলমে প্রকল্প রচনা করলেই তো হল না। তার বাস্তব রূপ দিতে টাকা প্রয়োজন। সে সব নিয়েই এখন আলোচনা চলছে।”

তারকেশ্বর মন্দির চত্বরে পুণ্যার্থীদের জন্য পরিষেবা নিয়ে অভিযোগ মানতে নারাজ পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান উত্তম কুন্ডু। তাঁর কথায়, “মন্দির কর্তৃপক্ষ এবং পুরসভা সব সময় এ সব বিষয়ে সজাগ।” তাঁর দাবি, “পুণ্যার্থীরা এখানে নিরাপদ। এত মানুষ আসেন ছোটখাটো ঘটনা ঘটতেই পারে। তাতে শোরগোল করার কিছু নেই। তারকেশ্বর মন্দির নিয়ে সরকারেরও উন্নয়নমুখী অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। সে সব বাস্তবায়িত করার জন্য কাজ চলছে।”

পুরকর্তৃপক্ষ যে পরিকল্পনার ঝুলিই মেলে ধরুন, মন্দির চত্বরে কান পাতলে কিন্তু ধরা পড়ছে ভিন্ন সুর।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE