সতর্কতা। হরিপালে (বাঁদিকে)। ডানদিকে, গোঘাটের সাতবেড়িয়ায় আমোদরের উপর সেতু মেরামত করা হচ্ছে।-নিজস্ব চিত্র।
লস্করপুরে দেহটা আসতে তখনও মিনিট পাঁচেক দেরি। এক কিলোমিটার দূরে মুল্লুকপুরের মোড়ে তখন ভিড়টা সবে ঘন হতে শুরু করেছে। গোঘাট হয়ে বদনগঞ্জ যাওয়ার পথে পথচলতি গাড়িগুলি ভিড়াটার দিকে এক বার জিজ্ঞাসার দৃষ্টি বুলিয়ে নিচ্ছিল।
স্বর্গযাত্রা লেখা গাড়িটা মুল্লুকপুর দিয়ে ছুটতেই ভিড়টাও ছুটতে শুরু করল সে দিকে। সাইকেলে, মোটরবাইকে, দৌড়ে কী ভাবে নয়! আটচল্লিশ বছরের কাজলবাবুর (ঘোষ) দেহ প্লাস্টিকে মোড়া ছিল। সঙ্গী গোঘাট পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ শেখ ফরিদ বলছিলেন, “শনিবার আমোদরের জল রাস্তা উপচে তিন কিলোমিটার দূরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল কাজলদাকে। গাছে আটকে গিয়েছিল দেহট। তাই ডুবুরি নামিয়ে আমরা খুঁজে পাইনি। শেষ পর্যন্ত গ্রামের লোকই দেহটা দেখতে পায়। পাছে ভেসে যায় তাই গাছের সঙ্গে পা’টা বেঁধে রাখতে হয়েছিল। আজ সকালে ডুবুরিরা দেহটা আমাদের হাতে তুলে দেয়।”
বস্তুত পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল, হুগলির আরামবাগ মহকুমার বিস্তীর্ণ অংশ দশকের পর দশক বন্যার এই বারোমাস্যা দেখে আসছে। বন্যার কাছে মানুষের অসহায় আত্মসমর্পণের ছবিটাও চেনা। রাজ্যে সরকার বদলেছে। কিন্তু বন্যার এই ছবি এতটুকু বদলায়নি। ডিভিসি-র ছাড়া জল মুণ্ডেশ্বরী, দামোদর, রূপনারায়ণ, শিলাবতী, আমোদরের জল বছরের পর বছর ভাসিয়েছে নিম্ন দামোদর অববাহিকার বর্ধমান, হুগলি, হাওড়ার বিস্তীর্ণ অংশকে। জীবন ও জীবিকা হারিয়েছেন শত শত মানুষ। কিন্তু সুরাহা মেলেনি। বন্যার আগেই সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, ২ হাজার ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি করে ইতিমধ্যেই কেন্দ্রের কাছে পাঠানো হয়েছে অনুমোদনের জন্য। রাজ্য সরকারের তরফে তদ্বিরও করা হচ্ছে। টাকা পেলেই কাজ আরম্ভ হবে।
প্রকৃতির রোষ যেমন এই তিন জেলার মানুষ দেখেছেন, তেমনই মন্ত্রী-সান্ত্রীদের প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরিও এখানকার মানুষের কাছে নতুন কিছু নয়। তাই বানভাসি মানুষ এখন দাবি তুলছেন, এ বার প্রতিশ্রুতি পালন করে দেখাক রাজ্য সরকার।
হরিপালের গবাটি গ্রামের বাসিন্দা বাবর আলির অসহায় জিজ্ঞাসা, ‘‘আর কতদিন এই ডাকাতিয়া খাল আমাদের সঙ্গে ডাকাতি করবে বলতে পারেন?’’ এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে বধর্মান, হুগলি, হাওড়ার তামাম বন্যার্তদের মুখে। পাণ্ডুগ্রামের লক্ষ্মী হেমব্রম উঠে এসেছেন স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে। বলছিলেন, ‘‘তারাজুলির জল এমন ভাবে ঠেল দিল, যে বাড়ি ছেড়ে এখানে চলে আসতে বাধ্য হলাম।’’
আমোদরের উপর বিধ্বস্ত সেতু মেরামতের কাজ তদারক করছিলেন গোঘাট ২ এর বিডিও শিবপ্রিয় দাশগুপ্ত। সন্ধ্যায় আরামবাগ শহরে ঢুকে দেখা গেল পুরপ্রধান স্বপন নন্দী ব্যস্ত হয়ে রাংতাখালি, বসন্তবাটি, চুঁয়াডাঙার পথে। বললেন, ‘‘আমাদের ছেলেরা এগারোশো গ্রামবাসীকে রান্না খাওয়াচ্ছে। অনেকে গ্রাম ছেড়ে আসতে চাইছেন না। নৌকায়ে তাঁদের খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।’’
স্বপনবাবুরা গ্রামে খিঁচুড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা বললেও ত্রাণ নিয়ে ক্ষোভ কম নেই। সোমবার সকালেই রূপনারায়ণের বাঁধ ভেঙে খানাকুল ২ ব্লকের ধান্যগোড়ি গ্রামের জল ঢুকতে শুরু করে। গ্রামেরই বাসিন্দা সমীরণ বেরা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘‘ত্রাণের কোনও ব্যবস্থা নেই. নিজেদের উদ্যোগেই একটি ধর্মশালায় ত্রাণ শিবির খুলেছি।’’
গ্রামবাসীদের ক্ষোভ যে অসঙ্গত নয়, জেলা প্রশাসনের এক কর্তার কথাতেই তার সায় মিলেছে। ওই কর্তা জানান, হঠাৎই রাস্তায় জল উঠে যাওয়ায় চাল, ডাল সব জায়গায় পৌঁছনো যায়নি। চাল পৌঁছলেই তা বিলি করা হবে।
বন্যার্তদের প্রশ্ন, ডিভিসি জল ছাড়ার অপেক্ষায় কেন সরকারি ত্রাণের চাল আটকে রইল। আগেই তো সে সব পৌঁছনো উচিত ছিল। আরামবাগ মহকুমা যে বন্যাপ্রবণ তা কি প্রশাসন জানে না?
উত্তর দেওয়ার মতো ধারে কাছে প্রশাসনের কাউকে দেখা গেল না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy