Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
ডোমজুড়

সংরক্ষণ নেই, নষ্ট হচ্ছে স্বাধীনতা সংগ্রামের নথি

স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম ধাত্রীভূমি ডোমজুড়। নীল বিদ্রোহ, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনঅগ্নিযুগের সেই সব দিনে সক্রিয় ভূমিকা ছিল ডোমজুড়ের মানুষের। পুরনো নথি এবং প্রবীণ মানুষের স্মৃতি অন্তত তেমনই বলছে। কিন্তু সেই সব নথি সংরক্ষণে প্রশাসনের উদাসীনতার অভিযোগ তুলেছেন শহরের বিশিষ্ট মানুষেরা।

স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্মৃতি বিজড়িত ডোমজুড়ের ঝাঁপড়দহ ডিউক স্কুল এবং সেই সেতু। ছবি: রমাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়।

স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্মৃতি বিজড়িত ডোমজুড়ের ঝাঁপড়দহ ডিউক স্কুল এবং সেই সেতু। ছবি: রমাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়।

অভিষেক চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:৫৮
Share: Save:

স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম ধাত্রীভূমি ডোমজুড়। নীল বিদ্রোহ, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনঅগ্নিযুগের সেই সব দিনে সক্রিয় ভূমিকা ছিল ডোমজুড়ের মানুষের। পুরনো নথি এবং প্রবীণ মানুষের স্মৃতি অন্তত তেমনই বলছে। কিন্তু সেই সব নথি সংরক্ষণে প্রশাসনের উদাসীনতার অভিযোগ তুলেছেন শহরের বিশিষ্ট মানুষেরা।

“গর্ব করার মতো ইতিহাসের সাক্ষী ডোমজুড়ের মাটি। কিন্তু সেগুলির বেশিরভাগ নমুনাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। যেটুকু রয়েছে সেগুলিও সংরক্ষণের কোনও চেষ্টা নেই।” আক্ষেপ প্রবীণ শিক্ষাবিদ দুঃখহরণ ঠাকুর চক্রবর্তীর। একই সঙ্গে তাঁর ক্ষোভ, বছর বছর কত অনুষ্ঠান হয় এই জনপদে। কিন্তু শিকড়কে ধরে রাখার কোনও চেষ্টাই হয় না। শিক্ষক কৌশিক চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, “ব্লক প্রশাসন থেকে পুরনো নথিগুলি সংরক্ষণ ও কিছু স্মারক তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হোক।”

ইতিহাস বলছে, ১৯২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর ব্রিটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জের বড় ছেলে প্রিন্স অব ওয়েলস কলকাতায় এসেছিলেন। ব্রিটিশ রাজত্বের প্রতি বিক্ষোভ দেখাতে সারা কলকাতায় সে দিন হরতাল হয়। তাতে ডোমজুড়ও সামিল হয়েছিল। এলাকার প্রবীণেরা জানান, ঝাঁপড়দহ ডিউক স্কুলে সে দিন ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়েছিল। শিক্ষকেরাও ধর্মঘট সমর্থন করেন। এর পরেই স্কুলটি ব্রিটিশ শাসকদের সন্দেহের তালিকায় চলে আসে। একটি বোমার মামলায় জড়িয়ে গ্রেফতার করা হয়েছিল বসন্ত ঢেঁকি নামে ওই স্কুলের এক ছাত্রকে। তাকে সাহায্যের অভিযোগ ওঠে সনৎকুমার সিংহ এবং গোষ্ঠবিহারী মুখোপাধ্যায় নামে দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে। সেই সময় স্কুলের প্রধান শিক্ষক সতীশচন্দ্র ঘোষের উপর চাপ বাড়ায় ব্রিটিশ গোয়েন্দা দফতর। ওই দুই শিক্ষক চাকরি না ছাড়লে স্কুল বন্ধ করার হুমকি দেওয়া হয়। সে কথা জেনে স্কুলের স্বার্থে চাকরি ছেড়ে দেন ওই দুই শিক্ষক। তাঁদের বিদায় অনুষ্ঠান হয়েছিল ডোমজুড় বাজারে।

স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক শ্যামসুন্দর দত্ত বলেন, ‘‘ইংরেজ পিু্লশ বসন্ত ঢেঁকিকে নানা অত্যাচার করলেও বিপ্লবী আন্দোলনের কোনও গোপন তথ্য জানতে পারেনি। পরে তিনি বেকসুর খালাস পেয়ে নারনায় নিজের গ্রামে ফিরে যান। স্কুলের পুরনো ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে এ সব অনেকটাই জানতে পেরেছি।’’ কিন্তু সেই ইতিহাস কত দিন রক্ষিত থাকবে তা নিয়ে সন্দিহান তিনি। কারণ, এই স্কুলের ব্রিটিশ আমলের নথিগুলি সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হতে বসেছে। পুরনো দিনের স্কুলবাড়ির পাশে নতুন ভবন তৈরি হয়েছে। তাঁর দাবি, “স্কুলের পুরনো বাড়িটিকে ‘হেরিটেজ’ ঘোষণা করুক সরকার। হাজিরা খাতা, সভার বিবরণীর মতো স্বাধীনতার আগের নথিগুলি যত দ্রুত সম্ভব সংরক্ষণ করা হোক।”

শিক্ষাবিদ দুঃখহরণবাবু জানান, ১৯৩০ সালে আইন-অমান্য আন্দোলনের প্রভাব পড়েছিল এই জনপদে। আফিম ও মদের দোকানে পিকেটিং করে জেলে গিয়েছিলেন ডোমজুড় ষষ্ঠীতলার ফটিকচন্দ্র ভট্টাচার্য, পরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, উত্তর ঝাঁপড়দহের হীরামোহন গঙ্গোপাধ্যায়, কালীপদ দে ও ডোমজুড় বারুইপাড়ার নগেন্দ্রনাথ হোড়। এঁদের গ্রেফতারের পরেই ডোমজুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করে ব্রিটিশ সরকার।

নীল বিদ্রোহেরও প্রভাব পড়েছিল ডোমজুড়ে। এই জনপদের দক্ষিণ ঝাঁপড়দহের জেলেপাড়ায় এক নীলকর সাহেবের কবর রয়েছে। এ ছাড়া ডোমজুড়ের পাশের গ্রাম খাঁটোরা গ্রামে নীল ভেজাবার চৌবাচ্চা ছিল বলেও অনেকে বলেন। শিক্ষাবিদ দুঃখহরণবাবুবাবু জানান, এই জনপদ ও তার আশপাশের গ্রামে ছাত্র ও যুবকদের নিয়ে বিপ্লবী সংগঠন তৈরি হয়েছিল। বোমাও তৈরি হত। কলকাতা থেকে গোপনে অস্ত্র ও বোমা তৈরির মশলা আসত। ডোমজুড় মহাশ্মশানের কাছে হরের পুলের কাছে অপেক্ষা করতেন ডোমজুড়ের বিপ্লবীরা। এর আশপাশেই অস্ত্রের হাতবদল হত।’’

ডোমজুড়ের বাসিন্দা সাহিত্যিক উল্লাস মল্লিকের খেদ, ‘‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্থানীয় ইতিহাস লিখিত রূপ পায় না। তাই আমরা পূর্বপুরুষদের লড়াইয়ের কথা জানতেও পারি না। অতীতের যে নথিগুলি পাওয়া সম্ভব সেগুলির সংরক্ষণ করতে হবে।’’ প্রবীণেরা জানান, ডোমজুড় থানার পুরনো নথিতে অনেকগুলি কেস ডায়েরিতে যুগান্তর দলের ডোমজুড় শাখা, ডোমজুড় বিল্পবী দলের মতো গুপ্ত সমিতির নাম রয়েছে। থানার এক কর্তা বলেন, “বহু পুরনো ইতিহাসের সাক্ষী এই থানা। সেই আমলের বাড়িটিতেই এখন থানার ডিউটি অফিসারের ঘর। স্বাধীনতার আগের নথিগুলির বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমরা শুনেছি কিছু নথি ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে।”

পুরনো নথি কি সংরক্ষণ করা হবে?

ব্লক প্রশাসনের দাবি, শহরের পুরনো নথিপত্র অনেক জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে। তা সংগ্রহ করে সংরক্ষণের পরিকল্পনাও রয়েছে। সম্প্রতি ‘ডোমজুড় কথা’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছে তারা। বিডিও তমোঘ্ন কর বলেন, ‘‘ডোমজুড় সমৃদ্ধ জনপদ। এখানে কয়েক মাস কাজ করার পরেই আমি স্থানীয় ইতিহাস লেখানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলাম। তাই পুস্তিকাটি বের করা গিয়েছে। ইতিহাস সংরক্ষণে জোর দেওয়া হবে।’’

সেটাই চান, ডোমজুড়ের বেশির ভাগ বাসিন্দা।

(চলবে)

কেমন লাগছে আমার শহর?
আপনার নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। Subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-ডোমজুড়’।
অথবা চিঠি পাঠান, ‘আমার শহর’, হাওড়া ও হুগলি বিভাগ, জেলা দফতর,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা- ৭০০০০১

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE