চালার মধ্যে রাখা রয়েছে রথ।
ভাঁড় নাচ, লেটোর গান, তরজা, বাউল— কৃষিতে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা উদয়নারায়ণপুরে এক সময়ে সংস্কৃতি চর্চা বলতে ছিল এইসব। সঙ্গে ছিল যাত্রা, নাটক। সিংটির শতাব্দীপ্রাচীন ভাই খাঁ পিরের মেলা ছি্ল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নিদর্শন। পেঁড়োর রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র মেলা, ভবানীপুরের রানি ভবশঙ্করী মেলাকে নিয়েও মেতে উঠত এ শহর।
মেলাগুলি এখনও চললেও কালের নিয়মে উধাও হয়েছে ভাঁড় নাচ, লেটোর গান, তরজা, বাউল, যাত্রা দল। বন্ধ হয়ে গিয়েছে নাটকের চর্চা। তবে, শতাব্দীপ্রাচীন রথযাত্রাকে ঘিরে বহু মানুষের সমাগম হয় এখনও। উদয়নারায়ণপুরের সংস্কৃতি-জগৎ নিয়মিত ভাবে যে বিষয়কে কেন্দ্র করে এখন আবর্তিত হচ্ছে, তা হল সাহিত্য চর্চা। কিন্তু কলকাতা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরের এই মফস্সল শহরে সাহিত্য চর্চা খুবই অসুবিধার। কেননা, নেই কোনও প্রেক্ষাগৃহ। তাই কোনও আলোচনাসভা, সাহিত্য পাঠ বা কবিতার আসর আয়োজন করতে গিয়ে নাজেহাল হন অনেকেই। অথচ, এই সাহিত্য চর্চাই কলকাতার সঙ্গে উদয়নারায়ণপুরের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ঘটিয়ে চলেছে। তাই সাহিত্যপ্রেমীরা অবিলম্বে শহরে প্রেক্ষাগৃহের দাবি তুলেছেন।
এ শহরের কবি অজিত বাইরি যেমন বলছেন, ‘‘উদয়নারায়ণপুরে কবিতা উৎসব বা সাহিত্যসভা করার জন্য পৃথক একটি অডিটোরিয়ামের খুব প্রয়োজন।’’ একই সুরে ‘ষাড়ঙ্গ’ পত্রিকার সম্পাদক সাতকর্ণী ঘোষও বলেন, ‘‘এখানে সমবায় ভবন বা স্কুলের বাড়িতে কবিতা উৎসব করতে হয়। কোনও প্রেক্ষাগৃহ না-থাকায় কলকাতায় গিয়েও অনুষ্ঠান করতে হয়। একটা প্রেক্ষাগৃহ থাকলে এই অসুবিধা হত না।’’
ভবশঙ্করী স্মৃতিমেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
এ শহর থেকে এক সময়ে ‘সারদা’, ‘শম্পা’, ‘ভোরের শিউলি’ প্রভৃতি পত্রিকা প্রকাশিত হত। কিন্তু এক সময়ে সেগুলি বন্ধ হয়ে যায়। এখন নিয়মিত প্রকাশিত হয় ‘ষাড়ঙ্গ’, ‘মেটে ফুল’, ‘সায়ন্তন’, ‘অভিযান’ প্রভৃতি পত্রিকা। স্থানীয়দের পাশাপাশি রাজ্যের নানা এলাকার কবি-সাহিত্যিকের লেখা এই সব পত্রিকায় প্রকাশিত হয় নিয়মিত ভাবে। সাহিত্য সংক্রান্ত নানা অনুষ্ঠানও করে থাকেন পত্রিকার উদ্যোক্তারা। যেমন ‘ষাড়ঙ্গ’ পত্রিকার পক্ষ থেকে মাসে একবার করে কবিতা উৎসব করা হয়। বছরে একবার সেই উৎসবই বড় ভাবে আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ থেকেও কবিরা আসেন। ‘কাস্তে কবি’ নামে পরিচিত কবি দীনেশ দাসকে নিয়ে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও করে থাকে ‘ষাড়ঙ্গ’। একই ভাবে ‘মেটে ফুল’ পত্রিকার তরফ থেকেও সাহিত্যের উপরে নানা কাজ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের নামে সংবর্ধনা, ‘মেটে ফুল স্মারক সম্মান’ প্রদান প্রভৃতি। ‘শম্পা’ পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলেও গত পঁচিশ বছর ধরে ‘শম্পা আবৃত্তি উৎসবে’র আয়োজন করা হয়।
কিন্তু কোনও অনুষ্ঠানই নির্দিষ্ট কোনও ঠিকানায় হয় না। ‘ষাড়ঙ্গ’-এর মাসিক কবিতা উৎসব হয় কলকাতার বাংলা অকাদেমির জীবনানন্দ সভাঘরে। বার্ষিক উৎসবটি হয় অবশ্য উদয়নারায়ণপুরেই। ‘মেটে ফুল’ পত্রিকাও কলকাতা এবং উদয়নারায়ণপুরে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে অনুষ্ঠান করে থাকে। সম্প্রতি, মেলা, সাহিত্য চর্চা এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারার সঙ্গে যুক্তদের নিয়ে সংস্কৃতি চর্চার একটি মূল ধারার প্রবর্তন করতে উদ্যোগী হয়েছেন এই জগতের মানুষজনই। তাঁদের উৎসাহ দিতে এগিয়ে এসেছেন বিধায়ক সমীর পাঁজা। তিনি বলেন, ‘‘মুক্ত মঞ্চ নামে নতুন সংগঠন তৈরি করা হচ্ছে। দলমত নির্বিশেষে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে যুক্ত মানুষজন তাতে থাকবেন। সকলকে নিয়ে ইতিমধ্যে একটা বৈঠক করা হয়েছে। মুক্ত মঞ্চের উদ্দেশ্য হবে উদয়নারায়ণপুরের সাহিত্য সংস্কৃতিকে বাইরের জগতে তুলে ধরা।’’
কিন্তু প্রেক্ষাগৃহ?
তার জন্য জায়গা খোঁজা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিধায়ক।
আশায় রয়েছেন সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের মানুষেরা।
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy