চলাফেরাই দায় মল্লিকঘাট ফুলবাজারে।
দেখতে দেখতে ১৩ বছর পার।
কেন্দ্রে ও রাজ্যে সরকার পাল্টেছে। কিন্তু ভাগ্য ফেরেনি কলকাতার মল্লিকঘাট ফুলবাজারের।
অথচ, মল্লিকঘাটে আধুনিক ফুলবাজার তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছিল সেই ২০০২ সালে। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় বাণিজ্য দফতর রাজ্য সরকারকে পাঁচ কোটি টাকা দিয়েছে। কিন্তু সময়ে খরচ করতে না পারায় সেই টাকা ফেরত নিয়ে নিয়েছে কেন্দ্র। রাজ্যের তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পরে তিন-তিন বার উদ্যানপালন দফতরে মন্ত্রী বদল হয়েছে। কিন্তু মল্লিকঘাটে আধুনিক ফুলবাজার তৈরির পরিকল্পনা পড়ে রয়েছে অথৈ জলে। যদিও রাজ্য সরকারের তরফে প্রকল্প রূপায়ণের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
১৩ বছর আগে কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষ গঙ্গা তীরের সৌন্দর্যায়নের জন্য সাবেক বাজারটি উচ্ছেদের পরিকল্পনা করে। সেই সময়ে ফুল ব্যবসায়ীরা এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। তৈরি হয় ‘সারা বাংলা ফুলচাষি ও ফুল ব্যবসায়ী সমিতি’। সমিতির উদ্যোগে চাষি ও ব্যবসায়ীরা রাজ্যের উদ্যানপালন দফতরের কাছে একটি আধুনিক ফুলবাজার গড়ে তোলার দাবি জানান। তাঁদের বক্তব্য ছিল, আধুনিক ফুলবাজার হলে এক দিকে ব্যবসায়ীদের সমস্যা মিটবে, অন্য দিকে গঙ্গা তীরের সৌন্দর্যায়নও হবে।
সমিতির সেই প্রস্তাবে গুরুত্ব দিয়ে উদ্যানপালন দফতরের কর্তারা বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রস্তাবটি মেনে নেন। তাঁরা আধুনিক ফুলবাজার তৈরির জন্য ৩৪০০ বর্গমিটার জমি উদ্যানপালন দফতরকে ‘লিজ’ দেয়। কিন্তু তার পরে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। সমিতি অবশ্য এখনও আধুনিক ফুলবাজারের দাবি থেকে সরেনি। সমিতির পক্ষে নারায়ণ নায়েক বলেন, “অনেকটা সময় চলে গিয়েছে। আমরা চাই দ্রুত ফুলবাজার গড়ে উঠুক।”
ফুলবাজার পরিচালন সমিতির সভাপতি বলেন তৃণমূল নেতা স্বর্ণকমল সাহা। তাঁর দাবি, আধুনিক ফুলবাজার তৈরির জন্য জোরকদমে নামা হয়েছে। তিনি বলেন, “আগের বার যে সমস্যা হয়েছিল তা মেটাতে আটঘাট বেঁধে নামা হয়েছে। বাজার তৈরির সময় যে সব ব্যবসায়ীকে সাময়িক ভাবে সরে যেতে হবে তাঁরা যাতে নতুন বাজার তৈরির পরে স্টল পান, সে ব্যাপারে তাঁদের সঙ্গে ফুলবাজার পরিচালন সমিতি ও উদ্যানপালন দফতরের পাকা চুক্তি হবে। পাশেই তাঁদের অস্থায়ী ভাবে বসানো হবে। সে জন্য কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষ যাতে কিছুটা জমি দেন সে ব্যাপারে তাঁদের সঙ্গে দফতরের মন্ত্রীর কথা হয়েছে।” উদ্যান পালন দফতর সূত্রের খবর, এ বারে প্রায় ৪৫ কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি হচ্ছে। এতে পাঁচতলা আধুনিক ভবন তৈরি হবে। এ বারেও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে টাকা চাওয়া হবে।
কিন্তু কী কারণে এত বছর ধরে আটকে রয়েছে প্রকল্পটি?
মল্লিকঘাটের ফুল বিদেশেও রফতানি হয়। সেই কারণে ১৩ বছর আগে প্রকল্পটির পরিকল্পনা করা হলে টাকার জন্য উদ্যানপালন দফতর যোগাযোগ করে কেন্দ্রীয় বাণিজ্য দফতরের সঙ্গে। উদ্যানপালন দফতর পাঁচতলা ভবন তৈরির পরিকল্পনা করে। খরচ ধরা হয় ২৫ কোটি ৯৩ লক্ষ টাকা। কেন্দ্রীয় বাণিজ্য দফতর ১০ কোটি টাকা দিতে রাজি হয়।
২০০৩ সালে তারা উদ্যানপালন দফতরকে আগাম ৫ কোটি দিয়ে দেয়। শুরু হয় বাজার সংস্কারের কাজ। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে ব্যবসায়ীদের সরানোর কথা হয়। এ জন্য পাশে কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি জমি ভাড়া নেওয়া হয়। কেন্দ্রের থেকে পাওয়া পাঁচ কোটি টাকায় ছাউনি করা হয় এবং জমির ভাড়া দেওয়া হয়। কিন্তু সমস্যাও শুরু হয় এখান থেকেই।
২০০৩ সালে প্রকল্প তত্ত্বাবধানের জন্য উদ্যানপালন দফতর ফুলবাজার পরিচালন সমিতি গঠন করে। ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার দায়িত্বও দেওয়া হয় সমিতিকে। সমিতি ব্যবসায়ীদের অস্থায়ী ছাউনিতে সরে যেতে বললেও তাঁরা সে কথা মানেননি। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ছিল, আধুনিক বাজার তৈরি হলে সেখানে তাঁরা স্টল পাবেন কিনা, সে বিষয়ে কোনও সুনিশ্চিত আশ্বাস দিতে পারেনি পরিচালন সমিতি। এই টানাপড়েনের মধ্যে ২০০৮ সালে পুরনো ফুলবাজারটি পুড়ে যায়। ব্যবসায়ীরা জঞ্জাল সরিয়ে ফের বসে পড়েন।
এ দিকে, আধুনিক বাজার তৈরি না-হওয়ায় ২০০৯ সালে কেন্দ্রীয় বাণিজ্য দফতর রাজ্য সরকারকে দেওয়া টাকা ফিরিয়ে নেয়। তার পর থেকে থমকে রয়েছে আধুনিক বাজার তৈরির কাজও। এর মধ্যে কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষের অনুরোধে অস্থায়ী ছাউনি ভেঙে নেওয়া হয়। উদ্যানপালন দফতরের কর্তাদের একাংশের অভিযোগ, পরিবর্তনের পরে বার বার এই দফতরে মন্ত্রী পরিবর্তনের জন্যই কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি।
২০০৩ সালে অস্থায়ী ভাবে ব্যবসায়ীদের বসানোর জন্য কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষ যে জমি দিয়েছিলেন তা নিয়ে তাদের সঙ্গে রাজ্য উদ্যানপালন দফতরের বিবাদ শুরু হয়েছে। ছাউনি ভেঙে নেওয়া হলেও বন্দর কর্তৃপক্ষ এখনও ভাড়া ধার্য করে চলেছে এবং বকেয়া ৮ কোটি টাকা চাইছে বলে উদ্যানপালন দফতরের দাবি। দফতরের মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু নারায়ণ চৌধুরী বলেন, “আমরা এত টাকা দিতে পারব না। টাকা কমানোর জন্য ভূতল পরিবহণ ও জাহাজমন্ত্রী নিতিন গড়কড়ির সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছি।”
এখনও সাবেক পদ্ধতিতেই এখানে ফুল কেনাবেচা হয়। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, নদিয়া, দুই পূর্ব ও পশ্চিম দুই মেদিনীপুর এবং হাওড়া জেলার কয়েকশো চাষি ও ব্যবসায়ী এখানে ফুল কেনাবেচা করতে চলে আসেন। ফুলবাজার পরিচালন সমিতি তাঁদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে জল সরবরাহ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং আলোর ব্যবস্থা করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy