চার-চারটে খুন। সেইসঙ্গে মারধরের একাধিক ঘটনা। ডাকাতি তো রয়েইছে। বস্তুত, গত তিন মাসে হুগলির জেলা সদর চুঁচুড়ায় দুষ্কৃতীদের তাণ্ডবে ত্রস্ত মানুষ।
কার্যত প্রশাসনকে যেন পাল্টা চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বার বারই জেলা সদরে নিজেদের সদম্ভ উপস্থিতি জানান দিচ্ছে সমাজবিরোধীরা।
দুষ্কৃতীদের বাগে আনতে জেলায় এক সময় অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের (সদর) নেতৃত্বে বিশেষ বাহিনী গড়া হয়েছিল। শহরের দুষ্কৃতীদে ঠেকাতে সেই স্পেশাল অপারেশন গ্রুপ (এসওজি) তল্লাশি চালাত নিয়মমাফিক। যার মাথায় ছিলেন একজন ওসি। কিন্তু সেই বিশেষ বাহিনী এখন অদৃশ্য। শহরে পুলিশি ব্যবস্থার সমস্ত ফাঁক ফোকর গলে একের পর এক ঘটতে থাকা অপরাধ নিয়ে তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। সোমবার ভরসন্ধ্যায় চুঁচুড়া স্টেশন চত্বরে ব্যবসায়ী খুনের ঘটনা সেই প্রশ্নকে আরও উস্কে দিয়ে বেআব্রু করে দিয়ে গেল গঙ্গাপারের এই শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে।
শহরের বাসিন্দা জেলাশাসক, পুলিশ সুপার, ডিআইজি বর্ধমান রেঞ্জ থেকে জেলা জজের মতো নামজাদা ভিভিআইপি-রা। অথচ সেখানেই দুষ্কৃতীরা একের পর এক অপরাধ ঘটিয়ে চলেছে। যার জেরে আতঙ্কিত শহরবাসী। এ হেন অবস্থায় পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলছেন অনেকেই। অভিযোগ যে একেবারেই অমূলক নয়, তার প্রমাণ চুঁচুড়া, হুগলি এবং ব্যান্ডেলের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে দুষ্কৃতীদের অবাধ বিচরণ, যা ক্রমশই মাত্রা ছাড়াচ্ছে। কোথাও সরাসরি খুন, কোথাও হামলা-ডাকাতি চলছে অবাধে।
গত মার্চেই স্টেশন লাগোয়া আইমাডাঙা আমবাগানের মধ্যে স্থানীয় ব্যবসায়ী তপন দে ওরফে খোকাকে দিনের আলোয় গুলি করে খুন করা হয়। তদন্তে নেমে চারজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু কেন খুন, তা নিয়ে এখনও ধন্দে পুলিশ। তপনের ঘটনার রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ফের খুন। এ বার হুগলি স্টেশন লাগোয়া কৃষ্ণপুর বাজারে। ভরসন্ধ্যায় ক্রেতাদের সামনেই একদল দুষ্কৃতী চায়ের দোকানে বসে থাকা পিটু ঝাঁ নামে এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর অবশ্য খুন নয়, ঘটে ডাকাতি। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে সকালের দিকে ব্যান্ডেল জিটি রোডে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে কয়েক লক্ষ টাকা হাতিয়ে চম্পট দেয় ডাকাতেরা। পুলিশ এখনও ডাকাতির কিনারা করতে পারেনি। এরপর ফের গুলি চলে চুঁচুড়ায়।। সাহাগঞ্জের কেওটা ঝাঁপপুকুর এলাকায় ডানলপ কারখানার চোরাই মাল নিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় মানুষ প্রতিবাদ করলে দুষ্কৃতীরা এলোপাথারি গুলি চালিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে এলাকায়। পুরভোটের ঠিক আগেই এমন ঘটনায়আতঙ্ক ছড়ায় এলাকায়।
এরপর ফের খুনের ঘটনা ঘটে হুগলিতে। হুগলির কানাগড়ে আমবাগানের দেখাশোনা করার সময় স্থানীয় যুবক পঙ্কজ চক্রবর্তীকে গুলি করে হত্যা করে পালিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা। মাথায় গুলি লাগায় চুঁচুড়া হাসপাতালে মারা যান পঙ্কজবাবু। এরপর সপ্তাহ কাটতে না কাটতেই আবার খুন। সোমবার ভরসন্ধ্যায় চুঁচুড়া স্টেশন লাগোয়া ময়নাডাঙা অঞ্চলের একটি ফাস্ট ফুডের দোকানের মালিক পীযূষ তালুকদারকে দোকান থেকে ডেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে দুষ্কৃতীরা। পীযূষবাবুকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত ঘোষণা করা হয়।
খুনের কারণ এখনও স্পষ্ট নয় পুলিশের কাছে। দোকান ছাড়া অন্য কোনও দিকে মাথা ঘামাতেন না পীযূষবাবু। এমনটাই জানিয়েছেন তাঁর পরিবার। পরিবারের দাবি, পীযূষবাবুকে যে যুবক দোকান থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল তার সঙ্গে টাকা নিয়েই তর্কাতর্কি চলছিল। পুলিশের অনুমান, দাবি মতো টাকা দিতে রাজি না হওয়াতেই তাঁকে খুন করেছে দুষ্কৃতীরা।
পুলিশের কাছে দোষীদের গ্রেফতার ও উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানিয়েছেন পীযূষবাবুর স্ত্রী চৈতালিদেবী। মঙ্গলবার সকালে নিহতের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, পরিবারের সকলেই শোকে কাতর। কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। কেন এই খুন, তার কোনও তল পাচ্ছেন না তাঁরাও।
চুঁচুড়ার বাসিন্দা অনিরুদ্ধ মজুমদার বলেন, ‘‘পর পর যা ঘটে চলেছে তাতে সম্প্রতি মানুষ ভীষণ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। দিন নেই, রাত নেই পুরো শহরটা যেন হঠাৎই দুষ্কৃতীদের মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠেছে। রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে গা-ছমছম করে। শহরের বিশেষ কিছু জায়গায় পুলিশি টহল থাকলে মানুষ ভরসা পাবে।’’ ব্যান্ডেলের বাসিন্দা তপন সমাদ্দার দুষ্কৃতীদের এমন বাড়-বাড়ন্তের জন্য পুলিশকেই দায়ী করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘ব্যান্ডেল অঞ্চলে দুষ্কৃতী তাণ্ডব এতটাই বেড়ে গেছে যে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপন ব্যাহত হচ্ছে। পুলিশ থেকেও নেই।’’
কী বলছেন জেলার পুলিশ সুপার সুনীল চৌধুরী?
তাঁর কথায়,‘‘প্রতিটি ঘটনাই তদন্ত হচ্ছে। পীষূযবাবুকে খুনের তদন্তও শুরু হয়েছে। দোষীদের খোঁজে তল্লাশি চলছে।’’
কিন্তু পুলিশি তৎপরতা সত্ত্বেও কেন বাগে আনা যাচ্ছে না দুষ্কৃতীদের সেই প্রশ্নও উঠেছে। আর তারই উত্তর খুঁজতে গিয়ে ঝুলি থেকে বেরিয়ে পড়েছে আর এক প্রশ্ন। দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে পুলিশের সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপানোর উদ্যোগ কেন থমকে যায় বার বার। উত্তর খুঁজতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের সঙ্গে রাজনীতির সেই বহু পুরনো সখ্যতার কাহিনীই ফের ঘুরেফিরে উঠে আসছে। এক সময় শহরের দুষ্কৃতীরা শাসকদল সিপিএমের কব্জায় ছিল। তাদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ উঠত সিপিএমের দাপুটে এক নেতার দলবলের বিরুদ্ধে। এখন শাসক দলের বদল ঘটায় দুষ্কৃতীদের ছাতাও বদলে গিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই শহরবাসী প্রশ্ন তুলেছেন শাসকরাই যেখানে দুষ্কৃতীদের নিয়ন্ত্রক সেখানে পুলিশের ঘাড়ে সব দায় চাপিয়ে লাভ কী?
রক্ষক নাকি ভক্ষক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy