Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ফুটবলেই ফিরুক গরিমা, চান শহরবাসী

হাওড়া-ব্যান্ডেল মেন লাইনের ধারে হুগলির জনপদগুলি একটা সময় ফুটবলার তৈরির আঁতুরঘর হিসাবে পরিচিত ছিল। যেগুলির অন্যতম ছিল রিষড়া। কলকাতার ফুটবল ময়দান তথা তিন প্রধান ক্লাবে (মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহমেডান) ভাল মানের একাধিক নামী খেলোয়াড়ের ফুটবল জীবন শুরু এই শহরেই। ফুটবল মানচিত্রে তাই রিষড়া বরাবরই সমীহ আদায় করে নিয়েছে।

শতবর্ষ পেরোনো রিষড়া স্পোর্টিং ক্লাব।

শতবর্ষ পেরোনো রিষড়া স্পোর্টিং ক্লাব।

প্রকাশ পাল
রিষড়া শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৫ ০১:১৫
Share: Save:

হাওড়া-ব্যান্ডেল মেন লাইনের ধারে হুগলির জনপদগুলি একটা সময় ফুটবলার তৈরির আঁতুরঘর হিসাবে পরিচিত ছিল। যেগুলির অন্যতম ছিল রিষড়া। কলকাতার ফুটবল ময়দান তথা তিন প্রধান ক্লাবে (মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহমেডান) ভাল মানের একাধিক নামী খেলোয়াড়ের ফুটবল জীবন শুরু এই শহরেই। ফুটবল মানচিত্রে তাই রিষড়া বরাবরই সমীহ আদায় করে নিয়েছে।

সুধীর কর্মকারের মতো ভারতবিখ্যাত ডিফেন্ডারের উঠে আসা এই শহরেই। পরবর্তীতে ময়দানের শেষ বাঙালি ‘মস্তান’ স্ট্রাইকার শিশির ঘোষ, সমীর চৌধুরীরা কলকাতা ময়দানের পাশাপাশি রাজ্য এবং জাতীয় দলে খেলেছেন। ঝুলি ভর্তি করে সাফল্য এনেছেন। চঞ্চল ভট্টাচার্য, সুপ্রিয় দাশগুপ্ত, রবি কর্মকাররাও বড় দলে খেলেছেন। আর তাই ফুটবলকে কেন্দ্র করে উন্মাদনার মাপকাঠিতে এই শহরের নামডাক যথেষ্টই। আর ভাল ফুটবলার জোগান দেওয়ার ফাঁকেই শহরের কোনও ক্লাব শতবর্ষ পেরিয়ে গিয়েছে, কোনও ক্লাব পালন করছে পঁচাত্তর বছর পূর্তি উৎসব।


পঁচাত্তরে সগৌরবে অরোরা ক্লাব।

রিষড়া স্পোর্টিং ক্লাব শতবর্ষ পেরিয়েছে ছয় বছর আগে। অরোরা ক্লাব এবং দি রিষড়া ক্লাব পা দিয়েছে পঁচাত্তরে। টাউন ক্লাবের মতো ঐতিহ্যশালী দলও রয়েছে শহরে। কলকাতা ময়দানে দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী সবুজ-মেরুন আর লাল-হলুদ শিবিরের মতো এ শহরেও দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী রিষড়া স্পোর্টিং এবং অরোরা মুখোমুখি হলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে শহরের ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে। দু’দলের সমর্থকরা এই ম্যাচকে সম্মানের লড়াই হিসেবে দেখেন। রিষড়া স্পোর্টিংয়ের ঘরের ছেলে শিশির। সুধীর অরোরার। এশিয়ান অল স্টার দলে সুযোগ পেয়েছিলেন সুধীর। ১৯৮২ সালে হয়েছেন ‘অর্জুন’। ফুটবল আলোচনায় হেডে গোল করার ক্ষেত্রে শিশিরের মুন্সিয়ানায় আজও মশগুল থাকেন ফুটবলপ্রেমীরা।

কিন্তু গঙ্গাপাড়ের এই ‘ফুটবল-আঁতুরঘর’-এ আজ যেন ভাটার টান। গত কয়েক বছরে উঠে আসছে না ভাল মানের ফুটবলার। যদিও নিয়ম করে ক্লাবগুলোতে সকাল-বিকেল প্র্যাকটিসে কোনও খামতি নেই। বছরভর চালু রয়েছে নানা প্রতিযোগিতাও। মোহনবাগানের কিংশুক দেবনাথ রিষড়া স্পোর্টিংয়ের খেলোয়াড় ছিলেন। এখন অবশ্য অরোরায়। কিংশুক ছাড়া রিষড়ার কোনও ক্লাব থেকেই বড় দলে খেলা ফুটবলার এই মূহূর্তে নেই। কিংশুক অবশ্য রিষড়ায় থাকেন না। তিনি শ্রীরামপুরের ছেলে। ফলে ফুটবলে রিষড়া শহরের উজ্জ্বলতা যে কমেছে, প্রাক্তন ফুটবলার থেকে ক্লাবের কর্মকর্তা সকলেই তা মানছেন। আর তারই ফাঁক গলে শহরে ক্রিকেটের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে। এমনটাই মনে করছেন তাঁরা। শহরের কয়েকটি ক্লাব সাব ডিভিশনে ক্রিকেট বা অ্যাথলেটিক্সের সঙ্গে যুক্ত। অথচ তাদের ফুটবল দল নেই।


স্মৃতির সরণি বেয়ে। ফুটবল সম্রাটের আলিঙ্গনে সুধীর।

সেই মাপের ফুটবলার আর উঠে আসছে না কেন? কেন এই ভাটার টান?

প্রশ্ন শুনে আক্ষেপের সুর প্রাক্তনদের গলায়, ‘‘এখন তো বাবা-মায়েরা ছেলেদের মাঠে পাঠাতেই চায় না। বিকেল হলে সব বইয়ের ব্যাগ পিঠে পড়তে যায়। টিভিতে কার্টুন দেখে। কিন্তু মাঠে আসে না।’’ তবে এর জন্য শহরে মাঠের অভাবকেও দায়ী করেছেন সত্তরের দশকে ময়দান কাঁপানো সুধীর। রিষড়া স্পোর্টিং তথা মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তা শেখর চট্টোপাধ্যায়ও সুধীরের সঙ্গে সহমত। গোটা রিষড়া শহরে খেলার জায়গা বলতে একমাত্র লেনিন মাঠ। বিভিন্ন সময়ে নানা প্রতিযোগিতা হয়। মাঠেই জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় ফি বছর মেলা বসে। নাগোরদোলা বা খাবার দোকানের স্টল অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন তৈরি করে যায় সবুজ ঘাসের বুকে। ক্রীড়াপ্রেমীদের ক্ষোভ, খেলার মাঠে মেলা বা অন্য কোনও অনুষ্ঠান কেন? বিশেষত যেখানে তেমন কোনও মাঠ আর নেই। এক প্রাক্তন ফুটবলারের খেদোক্তি, ‘‘লেনিন মাঠে বিয়েবাড়ির ম্যারাপ বাঁধাটুকুই শুধু বাকি।’’

রিষড়ার ফুটবল অতীত নিয়ে উচ্ছ্বসিত সমীর চৌধুরীর কথায়, ‘‘কী উন্মাদনাই না ছিল সেই সময়! কয়েক দশক ধরে এখানকার ফুটবলাররা কলকাতা তথা সারা দেশ কাঁপিয়েছে। আজ, ফুটবল খেলে যা উপার্জন, তখন তেমনটা ছিল না। খেলার প্রতি আগ্রহ আর ভালবাসাই ছিল মুখ্য। এখন সুযোগ-সুবিধা প্রচুর বেড়েছে। তা সত্ত্বেও ফুটবলের সেই আবেগ, ভালবাসা আর দেখতে পাই না। ফলে নিম্নমানের বিদেশিরা এখানে এসে মাঠ দাপাচ্ছে। তবে ছোট থেকে ছেলেদের ঘষেমেজে তৈরি করতে পারলে সমস্যা মিটবে।’’

শহরের ফুটবল উন্মাদনার আঁচ ভালই পেয়েছিলেন সুধীর। ’৭৭ সালে ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মোহনবাগানে আসার পরে তাঁর গাড়ি ভাঙচুর হয়েছিল ভক্তদের হাতে। সে কথা স্মরণ করে প্রাক্তন ফুটবলারের প্রতিক্রিয়া, ‘‘তখন এত টাকা ফুটবলে ছিল না। তবে ভালবাসা ছিল ভরপুর। জিতলে মানুষ মাথায় করে রাখত। হারলে বাড়ি ফিরতে সমস্যা হতো। এটাই জেতার খিদেটা আরও বাড়িয়ে দিত।’’ ভাল ফুটবলার তৈরি নিয়ে তাঁর পরামর্শ, ‘‘ছোট থেকে পরিকল্পনামাফিক ভাবে ছেলেদের গ়ড়ে তুলতে হবে। তাদের মাঠমুখি করে তুলতে হবে। অনেকেই খেলোয়াড় গড়তে চেষ্টার কসুর করেন না। তবে সঠিক সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তাঁদের হাত ধরেই আবার রিষড়া বা আশপাশের শহর থেকে ফুটবলাররা দাপিয়ে বেড়াবে কলকাতার মাঠ।’’

একটা সুধীর কর্মকার বা আর একটা শিশির ঘোষ কবে? আপাতত সে দিকেই পথ চেয়ে একদা ফুটবলের এই শহর।

(চলবে)

ছবি: দীপঙ্কর দে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE