Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
গুলিবিদ্ধের মৃত্যুতে তাণ্ডব, নির্বিকার পুলিশ

গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের আগুনে রণক্ষেত্র শালিমার

এলাকা জুড়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে দুষ্কৃতীরা। ভাঙচুর হচ্ছে। আগুন লাগানো হচ্ছে একের পর এক গাড়িতে। এক জায়গায় হাঙ্গামার পরে পুলিশ যখন সেখানে পৌঁছচ্ছে, তত ক্ষণে দুষ্কৃতীরা হাজির অন্য জায়গায়! সারা দিনে চরকিবাজি করে ন’টি ট্রেলার এবং চার চাকার একটি গাড়ি পুড়িয়েছে তারা।

পুড়ছে ট্রেলার। (ইনসেটে) বিনোদ সিংহ। শুক্রবার শালিমারে দীপঙ্কর মজুমদারের তোলা ছবি।

পুড়ছে ট্রেলার। (ইনসেটে) বিনোদ সিংহ। শুক্রবার শালিমারে দীপঙ্কর মজুমদারের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৫ ০২:৫১
Share: Save:

এলাকা জুড়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে দুষ্কৃতীরা। ভাঙচুর হচ্ছে। আগুন লাগানো হচ্ছে একের পর এক গাড়িতে। এক জায়গায় হাঙ্গামার পরে পুলিশ যখন সেখানে পৌঁছচ্ছে, তত ক্ষণে দুষ্কৃতীরা হাজির অন্য জায়গায়! সারা দিনে চরকিবাজি করে ন’টি ট্রেলার এবং চার চাকার একটি গাড়ি পুড়িয়েছে তারা।

শাসক-বিরোধী সংঘাত নয়। হাওড়ার শালিমারে শুক্রবারের এই ঘটনার পিছনে রয়েছে স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলরের সঙ্গে আর এক তৃণমূল নেতার গোলমাল। পুলিশ জানায়, শাসক দলের অন্দরের সেই গোলমালেই ৬ এপ্রিল গুলিবিদ্ধ হন কাউন্সিলর বিনয় সিংহের ভাই বিনোদ (৪০)। এ দিন সকালে তিনি মারা যান। গোলমাল ছড়ায় তার পরেই।

রাজ্য প্রশাসনের সদর দফতর নবান্নের অদূরে শালিমারে দিনভর তাণ্ডব চললেও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। হাওড়া সিটি পুলিশের ডিসি (সদর) নিশাত পারভেজ বলেন, ‘‘হাঙ্গামাকারীদের দু’জনকে আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি।’’ এলাকার বাসিন্দাদে অভিযোগ, হাঙ্গামার সময় পুলিশ কার্যত দর্শকের ভূমিকা নিয়েছিল।

কেন এই গোলমাল?

পুলিশি সূত্রের খবর, শালিমার রেল ইয়ার্ডে মালপত্র খালাস নিয়ে স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর বিনয় সিংহ এবং শাসক দলেরই স্থানীয় নেতা প্রদীপ তিওয়ারির কাজিয়া দীর্ঘদিনের। তার জেরেই গুলিবিদ্ধ হন বিনয়ের ভাই বিনোদ ও ভাগ্নে রাজেশ। তাঁদের ভর্তি করানো হয় দক্ষিণ কলকাতায় একটি হাসপাতালে। আঙুল ওঠে প্রদীপ এবং তাঁর ছ’ভাইয়ের বিরুদ্ধে। পুলিশের দাবি, ঘটনার পর থেকেই তাঁরা এলাকাছাড়া।

এ দিন সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ বিনোদের মৃত্যুর খবর আসার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তাণ্ডবে মেতে ওঠে বিনয়ের সাঙ্গোপাঙ্গেরা। সাড়ে ১০টা নাগাদ এক দল যুবক (যাদের মধ্যে অনেকেই দুষ্কৃতী বলে পরিচিত) শালিমার রেল ইয়ার্ডের কাছে প্রদীপের একটি গাড়িতে আগুন লাগায়। পুলিশ সেখানে পৌঁছনোর আগেই হাঙ্গামাকারীরা অন্যত্র চলে যায়। কিছু পরেই ফোরশোর রোডে প্রদীপের পরিবহণ সংস্থার সামনে দাঁড়ানো তিনটি ট্রেলারে আগুন লাগানো হয়। পুলিশ ও দমকল যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, পুলিশের সামনেই দুষ্কৃতীরা তাণ্ডব চালাতে থাকে। পরে আরও চারটি ট্রেলারে আগুন লাগানো হয়। অভিযোগ, পুলিশ ছিল দর্শকের ভূমিকায়। সংখ্যাতেও কম
ছিল তারা। রাতে আগুন লাগানো হয় দু’টি ট্রেলারে।

শালিমার রেল ইয়ার্ডে রোজ গড়ে তিনটি মালগাড়ি থেকে মালপত্র খালাস হয়। সিমেন্ট ও ইস্পাতের চাদর, রডই প্রধান। সেই মালপত্র খালাসকে ঘিরে গড়ে ওঠা পরিবহণ ব্যবসায় বিনয় ও প্রদীপ, দু’জনেই যুক্ত। এবং তাঁদের কাজিয়া ব্যবসার দখল নিয়েই। এই খুনের মূল কারণ সেটাই বলে পুলিশের দাবি।

এলাকার নেতাদের একাংশ অবশ্য বলছেন, ব্যবসায়িক গোলমালের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বও আছে বিনয় ও প্রদীপের মধ্যে। বিনয় শালিমারের পুরনো কংগ্রেসকর্মী। গত পুরভোটে কংগ্রেসের টিকিটে দাঁড়িয়ে তৃণমূল প্রার্থী প্রদীপকে হারান। পরে দল বদলে চলে আসেন তৃণমূলেই। তখন থেকেই শালিমারে শাসক দলের দু’টি গোষ্ঠীর কাজিয়া শুরু হয়।

তাণ্ডবের পরে এ দিন শালিমারে যান কৃষি বিপণনমন্ত্রী তথা হাওড়া জেলার তৃণমূল সভাপতি অরূপ রায়। তিনি বলেন, ‘‘এটা ব্যবসায়িক গোলমাল। এতে রাজনীতি নেই।’’ শালিমারের পরিবহণ ব্যবসায়ী সংগঠনের সভাপতি কল্পনাথ রাই অবশ্য এ দিনের হাঙ্গামায় প্রদীপের শাগরেদদেরই হাত দেখেছেন। তিনি বলেন, ‘‘প্রদীপের লোকেরা নিজেদের গাড়িতে আগুন লাগিয়ে মূল ঘটনা থেকে নজর ঘোরাতে চাইছে।’’

প্রশ্ন উঠেছে, ব্যবসায়িক গোলমাল হোক বা রাজনৈতিক গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব— গুলি চালানোর ঘটনার এত দিন পরেও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারল না কেন?

হাওড়া সিটি পুলিশের বক্তব্য, রেল ইয়ার্ডে গুলি চালানোর ঘটনার তদন্ত করছে জিআরপি। সিটি পুলিশ তাদের সাহায্য করছে। খড়্গপুরের রেল পুলিশ সুপার (শালিমার দক্ষিণ-পূর্ব রেলের অংশ বলে প্রশাসনিক ভাবে খড়্গপুর ডিভিশনের অধীন) জয় বিশ্বাস জানান, ৬ এপ্রিলের ঘটনায় অভিযুক্তেরা ভিন্‌ রাজ্যে গা-ঢাকা দিয়েছে। তাই তাদের নাগাল পেতে সমস্যা হচ্ছে। রেল পুলিশ ও হাওড়া সিটি পুলিশের একটি যৌথ দল দুষ্কৃ়তীদের ধরার কাজে নেমেছে।

এ দিন পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকায় ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন বাসিন্দারা। তাঁদের প্রশ্ন, ভরদুপুরে এক দল দুষ্কৃতী তাণ্ডব চালালেও পুলিশ ব্যবস্থা নিল না কেন? ওমপ্রকাশ মিশ্র নামে এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘পুলিশ ১১ দিনেও গুলি চালানোর ঘটনায় কাউকে ধরতে পারেনি। এ দিনও চুপ করে থাকল!’’ অনুরাগ তিওয়ারি নামে এলাকার এক ব্যবসায়ীর আশঙ্কা, প্রদীপ ও বিনয়ের দলের গোলমাল এখনই থামবে না। চলতেই থাকবে এবং ভুগতে হবে বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের।

কী বলছে পুলিশ?

‘‘কলকাতায় পুরভোটের জন্য বাহিনীর একটি অংশ চলে যাওয়ায় কর্মী কমে গিয়েছে। তবু হামলার খবর পেয়েই পুলিশ ছুটে গিয়েছে,’’ দাবি হাওড়া সিটি পুলিশের কর্তাদের।

বিকেলে বিনোদের দেহ শালিমারে পৌঁছনোর পরে এলাকা ফের কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে উঠলেও গোলমাল ছড়ায়নি। শিবপুর শ্মশানে রাতেই শেষকৃত্য হয়। সকালে পুলিশ কম থাকলেও সন্ধ্যায় শ্মশানে পর্যাপ্ত পুলিশ দেখা গিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE