Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

একশো দিনের টাকায় ঢালাই রাস্তা কেন, উঠেছে নানা প্রশ্ন

এক দিকে গ্রামবাসীর দাবি, অন্য দিকে প্রকল্পের আইনি নির্দেশরেখা— দুইয়ের মধ্যে কোনটি ঠিক। সেই প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি। তার মধ্যেই গ্রামে ইটের রাস্তা তুলে দিয়ে একের পর এক তৈরি করা হচ্ছে ঢালাই রাস্তা। টাকা জোগাচ্ছে ১০০ দিন প্রকল্প।

এই সেই রাস্তা।  শ্যামপুরের বারগ্রামে সুব্রত জানার তোলা ছবি।

এই সেই রাস্তা। শ্যামপুরের বারগ্রামে সুব্রত জানার তোলা ছবি।

নুরুল আবসার
শ্যামপুর শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৫ ০১:৩৩
Share: Save:

এক দিকে গ্রামবাসীর দাবি, অন্য দিকে প্রকল্পের আইনি নির্দেশরেখা— দুইয়ের মধ্যে কোনটি ঠিক। সেই প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি। তার মধ্যেই গ্রামে ইটের রাস্তা তুলে দিয়ে একের পর এক তৈরি করা হচ্ছে ঢালাই রাস্তা। টাকা জোগাচ্ছে ১০০ দিন প্রকল্প।

হাওড়ার শ্যামপুর ২ পঞ্চায়েত সমিতির কর্তাদের দাবি, মানুষের দাবি মেনেই তাঁরা এই কাজে হাত দিয়েছেন। কিন্তু ইটের বদলে ঢালাই রাস্তার কথা শুনে ভুরু কুঁচকেছেন ১০০ দিনের প্রকল্পের রাজ্য স্তরের আধিকারিকেরা। তাঁদের বক্তব্য, ওই প্রকল্পের ৪০ শতাংশের বেশি টাকা নির্মাণ সামগ্রীর জন্য ব্যবহার করা যায় না। ষাট শতাংশই মজুরির জন্য বরাদ্দ থাকে, যাতে গরিব মানুষের রোজগার নিশ্চিত করা যায়। অথচ ঢালাই রাস্তা তৈরির বেশি খরচ যায় মালমশলায়।

শ্যামপুর ২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি জুলফিকার মোল্লা দাবি করেন, “ষাট শতাংশ টাকা মজুর বাবদ খরচ করে বাকি টাকাতেই আমরা ঢালাই রাস্তা তৈরি করছি।” সেটা কী ভাবে সম্ভব? তাঁর উত্তর, সামগ্রিক ভাবে অনেক বেশি টাকার কাজ করাচ্ছেন তাঁরা। মজুরির টাকা বাদ দিলেও বাকি যে ৪০ শতাংশ থেকে যাচ্ছে, তার অঙ্ক খুব কম নয়। সেই টাকাতেই ঢালাই রাস্তা তৈরি হচ্ছে। অনুপাত ঠিকই থাকছে।

জুলফিকার সাহেবের যুক্তি, একশো দিনের কাজের প্রকল্পে স্থায়ী সম্পদ তৈরি করতে বলা হয়। “ঢালাই রাস্তা তো স্থায়ী সম্পদ। এর ফলে এলাকার যে অর্থনৈতিক উন্নতি হবে তার মূল্য অনেক। সেটাই বা বিবেচনা করা হবে না কেন?” তাঁর সাফ কথা, ২০১৮ সালের মধ্যে ওই পঞ্চায়েত সমিতির অধীন আটটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার প্রতিটি ইট-পাতা রাস্তাই ঢালাই করা হবে। তিনি জানান, এই ব্লকের আটটির মধ্যে সাতটি গ্রাম পঞ্চায়েত বিশ্বব্যাঙ্কের ‘আইএসজিপি’ প্রকল্পের আওতায় পড়ে না। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা, গ্রাম পঞ্চায়েতের নিজস্ব কোনও তহবিল থেকেও ঢালাই রাস্তা তৈরির ব্যবস্থা নেই। ফলে ১৯৭৮ সাল থেকে ইট-পাতা রাস্তাই ছিল ভরসা। তাই পঞ্চায়েত সমিতি ১০০ দিনের প্রকল্প বেছে নিয়েছে।

১০০ দিনের প্রকল্পের রাজ্যের আধিকারিকেরা অবশ্য এতে খুশি নন। তাঁদের যুক্তি, কৃষি এবং কৃষিভিত্তিক সম্পদ সৃষ্টির জন্য বরাদ্দ টাকার অন্তত ৬০ শতাংশ খরচ করতে হবে বলে কেন্দ্রের নির্দেশ। বাকি যে ৪০ শতাংশ টাকা থাকবে, তাতে হাট-বাজারের মতো স্থায়ী সম্পদ তৈরি করতে হবে। রাস্তা তৈরির থেকে নিরস্ত হতেই বরং বলা হয়েছে নির্দেশিকায়। ফলে, ঢালাই রাস্তা তৈরির উদ্যোগ কতটা আইনসিদ্ধ, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

গ্রামের মানুষ যদি ঢালাই রাস্তা চান, পঞ্চায়েত তা করাবে না কেন? প্রকল্পের রাজ্য কমিশনার দিব্যেন্দু সরকার বলেন, “একশো দিনের প্রকল্পের উদ্দেশ্য, গরিবের রোজগার নিশ্চিত করা, রোজগার বাড়ানোর উপায় করা। এখানে ‘স্থায়ী সম্পদ’ বলতে সেই সব সম্পদ, যা দরিদ্রতম পরিবারের রোজগার বাড়াতে পারে।” তিনি বলেন, পোলট্রি শেড, গরু বা ছাগল রাখার শেড, বা ফলের বাগান তৈরি, এগুলির জন্য নির্মাণসামগ্রীর জন্য নির্দিষ্ট ৪০ শতাংশের চেয়ে বেশিও টাকা ঢালা যেতে পারে, কারণ তাতে কয়েক বছর একটি পরিবারের রোজগার বাড়ে। দিব্যেন্দুবাবুর দাবি, “গ্রামের দরিদ্রতম মানুষের কাছে ঢালাই রাস্তার চাইতে অনেক জরুরি মাথার উপরে ছাদ। তাই এই প্রকল্পের টাকা বরং ইন্দিরা আবাসের বাড়ি তৈরির কাজে খরচ করলে ঠিক হয়।”

পঞ্চায়েত দফতরের কর্তাদের অনেকেরই অভিজ্ঞতা, বস্তুত গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নানা সরকারি প্রকল্পের সুবিধে নিয়ে থাকেন বেশি। পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, নানা জেলাতে ঢালাই রাস্তা তৈরি হচ্ছে এই প্রকল্পের টাকা দিয়ে। এমনিতেই একশো দিনের কাজের প্রকল্পে রাস্তা তৈরি এবং পুকুর খোঁড়ার কাজ সব চাইতে বেশি হয়। সেই পুকুরগুলিও প্রায়ই এলাকার বড় পুকুর, যার মালিকানা বিত্তবানদের হাতে। এর ফলে সরকারি প্রকল্পের লাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রকৃত গরিব মানুষ।

বারগ্রাম পঞ্চায়েতে রাস্তা পেয়ে যাঁরা খুশি, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন চাষিরা। বারগ্রাম পঞ্চায়েতের মৌল গ্রামের প্রসাদচন্দ্র মেটে চার বিঘা জমিতে ধান চাষ করেন। এই সে দিনও তাঁকে মজুরদের মাথায় বস্তা চাপিয়ে ইটের রাস্তা পার করে ধানের বস্তা পাকা রাস্তা পর্যন্ত নিয়ে যেতে হত। তবে মিলত আড়তে যাওয়ার গাড়ি। বস্তা প্রতি মজুরদের ৩০ টাকা করে দিতেও হত। প্রসাদবাবু বললেন, “এখন আড়তদার নিজে ভ্যানো নিয়ে গ্রামে আসছেন। আমাদের লাভ বেশি হচ্ছে। ঢালাই রাস্তা না হলে কি এটা সম্ভব ছিল?”

স্পষ্টতই, একশো দিনের কাজের প্রকল্পের টাকায় লাভ হয়েছে জমির মালিকদের। ভূমিহীন খেতমজুর, দিনমজুরদের কতটা লাভ হবে, তাঁদের জন্য এই প্রকল্পের টাকা কতটা খরচ হবে, তার উত্তরও দিতে হবে পঞ্চায়েত সদস্যদের। কারণ পঞ্চায়েত কর্তারা স্পষ্টই বলছেন, “যদি মজুরির জন্য প্রকল্পের নির্দিষ্ট টাকা ব্যয় না হয়ে থাকে, খরচ বন্ধ করে দেব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE