Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

আর কত রক্ত দেখতে হবে, ক্লান্ত বাসিন্দারা

শুরুটা হয়েছিল ২০০৪ সালের ৯ মার্চ। ওই দিন বনগাঁ শহরের বক্সিপল্লি এলাকার বাসিন্দা অসীম অধিকারী নামে এক ব্যক্তিকে দুষ্কৃতীরা গাইগাটা থানার দোগাছিয়া এলাকায় যশোহর রোডে তাড়া করে গুলি-বোমা মেরে খুন করে। অসীম বাইকে করে যাচ্ছিল। পিছন থেকে অন্য একটি মোটরবাইকে চেপে হানা দেয় আততায়ীরা। খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছিল। অসীমের বিরুদ্ধেও অবশ্য পুলিশের খাতায় খুন-তোলাবাজি-সহ নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল।

সীমান্ত মৈত্র
বনগাঁ শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৪ ০২:১৬
Share: Save:

শুরুটা হয়েছিল ২০০৪ সালের ৯ মার্চ।

ওই দিন বনগাঁ শহরের বক্সিপল্লি এলাকার বাসিন্দা অসীম অধিকারী নামে এক ব্যক্তিকে দুষ্কৃতীরা গাইগাটা থানার দোগাছিয়া এলাকায় যশোহর রোডে তাড়া করে গুলি-বোমা মেরে খুন করে। অসীম বাইকে করে যাচ্ছিল। পিছন থেকে অন্য একটি মোটরবাইকে চেপে হানা দেয় আততায়ীরা। খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছিল। অসীমের বিরুদ্ধেও অবশ্য পুলিশের খাতায় খুন-তোলাবাজি-সহ নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল।

দুষ্কৃতীদের হাতে অসীম খুন হওয়ার পর থেকে বক্সিপল্লি, সিকদারপল্লি, সুভাষপল্লি এলাকায় একের পর এক খুনের ঘটনার সাক্ষী থেকেছেন এলাকার মানুষ। পুলিশের হিসাবে অসীম খুনের পর ৬ জন খুন হয়েছে এখনও পর্যন্ত। এলাকায় ধারাবাহিক খুনের ঘটনার ‘ট্র্যাডিশন’ আজও অব্যাহত। তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন রবিবার সন্ধ্যায়। রাত ৮’টা নাগাদ দুষ্কৃতীরা গুলি করে খুন করেছে স্থানীয় বাসিন্দা বিন্দু বক্সিকে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, অসীম খুনের পরে একে একে দুষ্কৃতীদের হাতে খুন হয়েছেন গোপাল সেন, অর্ধেন্দু ঘোষ ওরফে টেকো, পরিমল বসু, খোকা ঘোষ, বাপি বিশ্বাস ওরফে মোটা বাপি। এলাকার মানুষ সে সব নিয়ে অবশ্য প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চান না। চাপা আতঙ্ক ছড়িয়ে থাকে গোটা এলাকায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবীনের কথায়, “কোনও সভ্য সমাজে আছি বলে মনে হয় না। দিনের পর দিন এমন ঘটনা ঘটেই চলেছে। রক্ত দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত।”

কেমন সেই আতঙ্কের চালচিত্র?

বনগাঁ শহরের ১ নম্বর রেলগেট থেকে বক্সিপল্লি পর্যন্ত যশোহর রোডের দু’ধারের বাসিন্দারা বেশি রাতে যাতায়াত করতে ভয় পান। দোকানপাট বেশি রাত পর্যন্ত খোলা থাকে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক একেকটা ঘটনা ভুলতে চান স্থানীয় মানুষ। ফের একটি ঘটনা ঘটে যায়। যেমন ঘটেছে রবিবার। কয়েক জন প্রবীন নাগরিক জানালেন, বেশিরভাগ খুনের ঘটনা ঘটেছে প্রকাশ্যে।

দুষ্কৃতীদের এলাকা দখলের লড়াই, পুরনো শত্রুতা, চোরাচালানের সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে যোগ আছে বেশির ভাগ ঘটনার। এক ব্যক্তির কথায়, ‘‘কোনও ঘটনা ঘটে গেলে কিছু দিন পুলিশের তৎপরতা দেখা যায়। টহল শুরু হয়। অপরাধীরাও হয় তো কেউ কেউ ধরা পড়ে। কিন্তু ফের ঘটে যায় কোনও না কোনও ঘটনা। ছেলেরা যত ক্ষণ বাড়ি না ফেরে, আত্মীয়-পরিজন চিন্তায় থাকেন।”

পুলিশের দেওয়া তথ্য ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গেল, পরিমল বসু ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি খুন হন অফিস থেকে ভ্যানে করে বাড়ি ফেরার পথে। যশোহর রোডের উপরেই তাঁকে দুষ্কৃতীরা গুলি করে খুন করে। তার কিনারা এখনও হয়নি। ২০০৫ সালের ৮ জানুয়ারি খুন হন গোপাল সেন। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেফটিক ট্যাঙ্কের মধ্যে থেকে মেলে বাপি বিশ্বাস নামে এক ব্যক্তির দেহ।

জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, “প্রায় সব ক’টি খুনের ঘটনারই কিনারা হয়েছে। দুষ্কৃতীরা গ্রেফতারও হয়েছে।” পুলিশ জানিয়েছে, সম্প্রতি গোপালনগর থানা এলাকা থেকে প্রশান্ত বৈদ্য নামে এক ‘সুপারি কিলার’ ধরা পড়েছে। জেরায় সে স্বীকার করেছে, মোটা বাপিকে সে-ই খুন করেছে। পরিমলবাবুর খুনের ঘটনাতেও সে যুক্ত। স্থানীয় বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাসের কথায়, “সিপিএমের সময়ে দুষ্কৃতীরা ওই এলাকায় তাণ্ডব করত। আমরা অনেকটাই কমিয়েছি।” কিন্তু যে যা-ই বলুন না কেন, পরিস্থিতি যে বদলায়নি, রবিবারের ঘটনা তা আরও এক বার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেল।

কী হয়েছিল রবিবার?

বিন্দুবাবু বাড়ির কাছেই যশোহর রোডের পাশে পঙ্কজ গোলদারের চায়ের দোকানে গিয়েছিলেন। মোটরবাইক থেকে নামতে যাবেন, সে সময়ে দুই দৃষ্কৃতী তাঁকে খুব কাছ থেকে গুলি করে পালায়। ওই দোকানে বিন্দুবাবু প্রায়ই তাস খেলতে যেতেন। পঙ্কজবাবু বলেন, “দোকান বন্ধ করার জন্য জিনিসপত্র গোছাতে ব্যস্ত ছিলাম। হঠাৎ শুনি গুলির আওয়াজ। দেখলাম বিন্দুর দেহ রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে আশপাশ।” সে সময়ে দোকানে জনা পনেরো লোকজন ছিল। তাঁদের চিৎকারেই পালায় দুষ্কৃতীরা।

সোমবার রাত পর্যন্ত বিন্দু খুনের ঘটনায় কাউকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি। কয়েক জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এ দিন সকালে জেলার পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী ও জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বনগাঁয় আসেন। সঙ্গে ছিলেন এসডিপিও মীর সহিদুল আলি ও আইসি নন্দন পানিগ্রাহী। ভাস্করবাবু বলেন, “খুনের কারণ পরিষ্কার নয়। দুষ্কৃতীদের ধরতে একটি বিশেষ তদন্ত টিম তৈরি করা হয়েছে। বেশ কিছু তথ্য হাতে এসেছে। তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”

নিহতের বড় ছেলে মন্টু থানায় খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন। তবে নির্দিষ্ট কারও নাম জানাননি। বিন্দুবাবুর বাড়িতে গিয়ে এ দিন দেখা গেল, স্ত্রী সরস্বতীদেবী ঘরে শুয়ে কাঁদছেন। মেয়ে বুলটি ও প্রতিবেশীরা তাঁকে সামাল দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন। বুলটি বনগাঁ দীনবন্ধু মহাবিদ্যালয়ে বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্রী। বিন্দুবাবুর দুই ছেলে মন্টু এবং মিন্টু। টিন-কাঠের ঘরে দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। সরস্বতীদেবী বলেন, “রবিবার বিকেল ৫টার সময়ে উনি মোটরবাইক নিয়ে বেরিয়েছিলেন। রাত ৮টা নাগাদ একজন এসে খবর দিল, কারা যেন ওঁকে মেরে পালিয়েছে। গিয়ে দেখি রাস্তায় পড়ে রয়েছেন স্বামী।” ঘটনার পিছনে রাজনৈতিক কারণ আছে বলে মনে করেন না পরিবারের লোকজন।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, কয়েক মাস আগে পাচারের গরু গোনার কাজ করতেন বিন্দু। সম্প্রতি মাস দু’য়েক ধরে সে সব বন্ধ। পারিবারিক কিছু জমি বিক্রি করে দুই ছেলেকে দু’টি অটোরিকশা কিনে দিয়েছিলেন। তারমধ্যে একটি অটো বাড়িতেই থাকে।

রবিবার রাতে বিন্দুকে দলীয় কর্মী দাবি করে স্থানীয় বিধায়ক বিশ্বজিৎবাবু বলেছিলেন, খুনের পিছনে বিজেপির মদতপুষ্ট দুষ্কৃতীদের হাত রয়েছে। জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “বিন্দু আমাদের দলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। জেলা পুলিশ সুপারকে বলা হয়েছে, দ্রুত দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার করতে।” বিজেপি নেতা কেডি বিশ্বাস অবশ্য দাবি করেছিলেন, ওই খুন তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দলের ফল। নিহত ব্যক্তি অসামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলেও দাবি করেছিলেন তিনি। পুলিশ অবশ্য খুনের পিছনে রাজনৈতিক কারণ এখনও পায়নি।

এলাকাটি ২২ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়ে। ওয়ার্ডের প্রাক্তন কাউন্সিলর তৃণমূলের বিনয়রতন পোদ্দার বলেন, “যে কোনও মৃত্যুই দুঃখজনক। কী কারণে একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছে জানি না, তবে পুলিশকে বলেছি, দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার করে এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

simanta maitra bongaon blood shed
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE