ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রির দশা সুন্দরবন দুগ্ধ সমবায় সমিতির (সুন্দরবন মিল্ক ইউনিয়ন)। গত তিন মাসে যে পরিমাণ দুধ চাষিদের কাছ থেকে সংগ্রহ হয়েছে, তা বিক্রি করে প্ল্যান্ট চালানোর খরচা উঠছে না বলে দাবি করছেন কর্তারা। যে কারণে মঙ্গলবার থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় দুধ সংগ্রহই বন্ধ করে দিলেন তাঁরা। সমবায় সূত্রের খবর, আপাতত আগামী আট মাস ‘লিন সিজনে’ (যখন দুধের জোগান কমে যায়) দুধ সংগ্রহ করা হবে না। বছরের তিন মাস দুধ সংগ্রহের ‘ফ্ল্যাশ সিজন’ (১৫ জুন থেকে ১৫ অগস্ট। এ সময়ে জোগান বেশি থাকে) কাজ হবে।
কিন্তু তা হলে সমবায়ের ৬ জন কর্মীর কী হবে, সেই প্রশ্ন উঠছে। তাঁরা কী কর্মহীন হয়ে পড়বেন? এখনই সেই আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন দুগ্ধ সমবায় সমিতির কর্তারা। তাঁদের বক্তব্য, এক লিটার দুধ তৈরিতে খরচ পড়ে ২৭ টাকা। কিন্তু গো-পালকদের কাছ থেকে তা কেনা হয় লিটার-পিছু ২১ টাকা (ফ্ল্যাশ সিজনে ২০ টাকা) দরে। কিন্তু দুধের জোগান দিনের পর দিন কমতে থাকায় সংগ্রহ করা এই দুধ মাদার ডেয়ারিকে পাঠানো আর লাভজনক থাকছে না। উল্টে এমনটা চলতে থাকলে দৈনিক ক্ষতি দাঁড়াবে প্রায় ৭০-৮০ হাজার টাকা। যে কারণে, আপাতত কিছু দিনের জন্য দুধ সংগ্রহের সিদ্ধান্ত বন্ধ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সমবায় সমিতির ম্যানেজিং ডিরেক্টর অমিতাভ সিংহ। সরকার কী এই বিশাল ক্ষতির ভার বহন করবে, সে প্রশ্নও তুলেছেন তিনি।
২০০৩ সালে চালু হওয়ার পর ২০০৭ পর্যন্ত চার বছরে এই দুগ্ধ সমবায় সমিতির ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২২ লক্ষ ২৪ হাজার টাকা। ২০০৭ সালের পর থেকে একটু একটু করে লাভের মুখ দেখতে শুরু করে এই সমবায়। ২০১০-১১ সাল থেকে ১২-১৩ আর্থিক বছরে সর্বোচ্চ প্রায় ৪ লক্ষ টাকা লাভ হয়। ছোট সমবায় সমিতিগুলির কাছ থেকে দুধ নেওয়া বন্ধ না করেও সুন্দরবন সমবায় সমিতি দু’বছর আগে বাইরে থেকে লিটার প্রতি ৪৩ পয়সা লাভে দুধ কিনে তা মাদার ডেয়ারিকে সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই লভ্যাংশ থেকে কৃষকদের গো-খাদ্য, ওষুধপত্র দেওয়া হত। কিন্তু সমবায় সমিতিগুলির বাইরে থেকে দুধ কেনার সিদ্ধান্ত গত বছর থেকেই হঠাৎ বন্ধ করে দেয় জেলা পরিষদ। গো-খাদ্য, ওষুধপত্র সরবরাহ বন্ধ হয়। ফলে তাঁরা গরু চাষে উৎসাহ হারাচ্ছেন বলে অভিযোগ দীর্ঘ দিনের।
সুন্দরবন দুগ্ধ সমবায়ের চিলিং প্লান্টে দু’টি ৫ হাজার লিটারের ট্যাঙ্কার রয়েছে। কিন্তু এই দুধের মরসুমেও মাত্র দু’আড়াই হাজার লিটারের বেশি দুধ রোজ জমা হচ্ছিল না। গত এক সপ্তাহ ধরে প্লান্টে পূর্বজটার মতো বেশি দুধ উৎপাদকারী ছোট সমিতিগুলিও দুধ পাঠাতে পারছিল না। পূর্বজটা দুগ্ধ সমবায় সমিতির সম্পাদক গোকুল হালদার বলেন, “প্রতি কেজিতে একটু করে দুধ বেশি নেওয়াকে কেন্দ্র করে চাষি, সংগ্রহকারীদের সঙ্গে আমাদের মতানৈক্য হয়েছিল। সমিতির সাধারণ সভায় তা মিটিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তা-ও বেশ কিছু ক্ষুব্ধ চাষি দুধ নিয়ে আসছেন না।” দুধ সরবরাহকারী অন্যান্য সমিতিও দুধ পাঠানো কমিয়ে দিয়েছে। ফলে মন্দিরবাজার থেকে ডানকুনিতে মাদার ডেয়ারির প্লান্টে দুধ পাঠাতে যে গাড়ি ভাড়া দিতে হচ্ছে, তাতে পোষাচ্ছে না সুন্দরবন দুগ্ধ সমবায় সমিতির।
কঙ্কণদিঘির ও দুধ সংগ্রহকারী সুরজিৎ মণ্ডল বলেন, ‘‘গরুর খাবারের দাম প্রচণ্ড বেড়েছে। সে কারণে অনেকে এখন গরু পুষতে চাইছেন না। গত মরসুমেও আমি ঘুরে ঘুরে ৯৫-৯৮ লিটার দুধ সংগ্রহ করতাম। এখন তা ৬০ লিটারে নেমেছে।” ২০১৩-১৪ সালে ক্ষতির মুখে পড়ে সুন্দরবন দুগ্ধ সমবায়। মাদার ডেয়ারিকে দেওয়া দুধের পরিমাণ দিন দিন কমছে।
বড় সমবায় সমিতিগুলিকে বাইরে থেকে দুধ কেনা বারণ করলেও মাদার ডেয়ারি কিন্তু ওই সমস্ত বেসরকারি দুধ সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে সমবায় সমিতিগুলির চেয়ে বেশি দরেই দুধ কিনছে। একদিন দুধের গুণমান খারাপ হলে সমবায় সমিতিগুলির সারা সপ্তাহের ইনসেনটিভ কেটে নেওয়া হয়। কিন্তু বেসরকারি দুধ সরবরাহকারী সংস্থা খারাপ দুধ দিলে কেবলমাত্র সেই দিনের ইনসেনটিভই মার যায়। এই বৈষম্যের জেরেও সুন্দরবন দুগ্ধ সমবায় পিছিয়ে পড়ছে বলে দাবি করছেন সংস্থার কর্মকর্তারা।
জেলা পরিষদের প্রাণিসম্পদ কর্মাধ্যক্ষ মানবেন্দ্র হালদার বলেন, ‘‘আমাদের নীতি হল, সমিতির বাইরে থেকে দুধ কেনা হবে না। বরং দুগ্ধ উপাদক সমিতি বাড়িয়ে দুধের জোগান বাড়ানো হবে। তবে সরকারি দুধের দাম তো বাঁধা। তাই কৃষকদের যদি কিছু বাড়তি সাহায্য দিয়ে বন্ধ হয়ে থাকা সমিতিগুলিকে খোলানো যায়, সে ব্যাপারে চেষ্টা করব। এ ব্যাপারে সুন্দরবন সমবায় সমিতির যা সাহায্য দরকার আমরা করতে প্রস্তুত।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy