Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

টাকা, কাপড়ের বিনিময়ে সন্তানকে অন্যের হাতে তুলে দিলেন দরিদ্র দম্পতি

নতুন পোশাক আর নগদ ১ হাজার টাকার বিনিময়ে নিজেদের সদ্যোজাত পুত্র সন্তানকে অন্যের হাতে তুলে দিলেন এক দরিদ্র দম্পত্তি। ঘটনাটি জানাজানি হওয়ায় মঙ্গলবার সকাল থেকে ভিড় জমতে শুরু করে দেগঙ্গার হাদিপুর-ঝিকড়া ১ পঞ্চায়েতের পশ্চিম হাদিপুর গ্রামের মোল্লাপাড়ায়, আরিফ মোল্লার ভাঙাচোরা বাড়ির সামনে। আরিফ জানান, চরম অভাবের সংসারে চার ছেলেমেয়েকে গিয়ে হিমসিম খেতে হচ্ছে। সে জন্যই পঞ্চম সন্তানটিকে মানুষ করার জন্য অন্যের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

আরিফ-মিনু আর তাদের চার সন্তানের মাথা গোঁজার ঠাঁই। নিজস্ব চিত্র।

আরিফ-মিনু আর তাদের চার সন্তানের মাথা গোঁজার ঠাঁই। নিজস্ব চিত্র।

নির্মল বসু
দেগঙ্গা শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:০৪
Share: Save:

নতুন পোশাক আর নগদ ১ হাজার টাকার বিনিময়ে নিজেদের সদ্যোজাত পুত্র সন্তানকে অন্যের হাতে তুলে দিলেন এক দরিদ্র দম্পত্তি। ঘটনাটি জানাজানি হওয়ায় মঙ্গলবার সকাল থেকে ভিড় জমতে শুরু করে দেগঙ্গার হাদিপুর-ঝিকড়া ১ পঞ্চায়েতের পশ্চিম হাদিপুর গ্রামের মোল্লাপাড়ায়, আরিফ মোল্লার ভাঙাচোরা বাড়ির সামনে। আরিফ জানান, চরম অভাবের সংসারে চার ছেলেমেয়েকে গিয়ে হিমসিম খেতে হচ্ছে। সে জন্যই পঞ্চম সন্তানটিকে মানুষ করার জন্য অন্যের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু টাকা-পোশাক নিলেন কেন? আরিফ বলেন, “কেউ যদি ভালবেসে কিছু দিতে চায়, তাকে বারণ করি কী করে?” আরিফের ছেলের মা মিনু বলেন, “সন্তানকে বিক্রি তো করিনি, মানুষ করতে দিয়েছি।”

সদ্যোজাতটিকে যাঁরা নিয়েছেন, সেই হাফিজুল মণ্ডলের মা মাজিদা বিবির স্পষ্ট কথা, “দশ বছর বিয়ে হলেও ছেলের কোনও সন্তান নেই। তাই নাতি পেতে আমরা রীতিমতো ১০ হাজার টাকা খরচ করেছি। টাকাটা এক সঙ্গে হাতে দিলে খরচ করে ফেলতে পারে বলে বাকি ন’হাজার টাকা আরিফের গ্রামেরই এক জনের কাছে গচ্ছিত আছে। সময় হলেই ওই টাকা তারা হাতে পাবে। টাকা ছাড়াও আরিফদের নতুন কাপড়, লুঙ্গি, গামছা দিতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। মাজিদার কথায়, “লিখিত ভাবে দত্তক না নেওয়া হলেও আমরা কিন্তু শিশুটিকে মণ্ডল পরিবারের সদস্যের মর্যাদাই দেব। নাতি বড় হলে ওকে ওর সমস্ত অধিকারও বুঝিয়ে দেওয়া হবে।”

কিন্তু এ ভাবে কী এক জনের সন্তানের দায়িত্ব নিতে পারে অন্য জন?

রাজ্যের সমাজকল্যাণ দফতর সূত্রের খবর, এ ভাবে কখনওই নিজের সন্তানকে হস্তান্তর করা যায় না। সে জন্য নির্দিষ্ট আইনি প্রক্রিয়া আছে। যা মেনে না চললে ভবিষ্যতে নানা আইনি জটিলতা দেখা দিতে পারে। কমিশনার সোমনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, “যে সব মহিলা বা পরিবার অর্থের অভাবে সন্তান প্রতিপালন করতে পারেন না, তাঁদের বাচ্চার দেখাশোনার জন্য আমাদের দফতরের কটেজ হোম রয়েছে। সেখানে বাচ্চার থাকা, খাওয়া, জামাকাপড়ের ব্যবস্থা থাকে। তাকে অন্তত মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পড়াশোনাও করানো হয় নিখরচায়।” জেলা পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে, বিষয়টি তারা শুনেছে। কিন্তু কোনও পক্ষ অভিযোগ না জানানোয় এ ক্ষেত্রে কিছু করার নেই।

দরমার বেড়ার উপরে টিন আর পলিথিনের ছাউনি দেওয়া ভাঙাচোরা ছোট্ট একটা ঘরে কোনও রকমে মাথা গুঁজে থাকেন অসুস্থ আরিফ ও তাঁর স্ত্রী মিনু বিবি। চারটি সন্তান তাঁদের। ওলিয়ার, রাকিয়া, আসিফুল এবং সোনিয়া। বড় আর সেজো ছেলে দিনমজুরি করে। মেজো মেয়ে পরিচারিকা। ছোট মেয়ে সবে চার বছরের। শুক্রবার বাড়িতেই পঞ্চম সন্তানটি প্রসব করেন মিনু। সামান্য রোজগারে সংসার এবং স্বামীর ওষুধপত্রের খরচ চালাতে জেরবার তিনি। দুধের শিশুকে বাঁচানোর পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না মিনুরা। ইতিমধ্যে খোঁজ আসে, বেড়াচাঁপা ২ পঞ্চায়েতের যাদবপুর গ্রামের পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা পেশায় রাজমিস্ত্রি হাফিজুল মণ্ডলের। নাসিমা বিবির সঙ্গে বহু বছর আগে বিয়ে হলেও নিঃসন্তান তাঁরা। সংসারে টাকার অভাব নেই। কিন্তু সন্তানের মুখ দেখতে পাননি কেউ। তা নিয়ে সংসারে অশান্তি লেগেই থাকে।

হাফিজুল ছোটেন আরিফের বাড়িতে। আলোচনার পরে সোমবার রাতে নগদ ১ হাজার টাকা এবং স্বামী-স্ত্রীর জন্য জামাকাপড় দিয়ে সদ্যোজাতকে শিশুটিকে নিয়ে নেন হাফিজুলরা।

স্থানীয় পঞ্চায়েতের সদস্যা হালিমা বিবি খবর পেয়ে যান মোল্লা বাড়িতে। তিনি বলেন, “পরিবারটির সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, অভাবের জন্যই তাঁরা পঞ্চম সন্তানকে বিক্রি করেছেন। ওঁদের অবস্থা এতটা খারাপ জানা ছিল না। পঞ্চায়েত থেকে সাধ্যমতো সাহায্য করা হবে।” স্থানীয় বাসিন্দা শেখ আক্তারুল, সাহাজুদ্দিন মোল্লারা বলেন, “এমনিতেই এখানকার বেশির ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে। প্রয়োজনীয় সরকারি সাহায্যও পায় না। মোল্লা পরিবার যদি ইন্দিরা আবাস যোজনায় অন্তত একটা ঘর পেত, তা হলে মনে হয় সন্তান বিক্রির পথে যেত না।”

এ দিন দুপুরে বারাসতের গোলাবাড়িতে জিরেনগাছা গ্রামে নাসিমার বাপের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, তিনি আগলে রেখেছেন ছেলেকে। নাম রাখা হয়েছে নাসিরুদ্দিন। হাফিজুল বলেন, “সন্তান না হওয়ায় স্ত্রীকে নানা কথা শুনতে হত। বাদ যেতাম না আমিও। তাই ঠিক করেছিলাম, সন্তান দত্তক নেব। ওই শিশুকে আমরা মানুষ করব বলে নিয়েছি। অন্য কেউ যদি নিয়ে নেয়, সে জন্য তাড়াহুড়ো করায় আইনি কাজটুকু সারা হয়নি। সে সব শীঘ্রই করে ফেলব।” মাজিদা বলেন, “অত আইন-কানুন জানি না। কিন্তু কেউ যদি ছেলেকে মানুষ করতে না পেরে আর এক জনকে দিয়ে দেয়, তাতে অন্যায়টাই বা কোথায়?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

southbengal nirmal basu deganga
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE