জখম অদিতি অধিকারী। বনগাঁয় নির্মাল্য প্রামাণিকের তোলা ছবি।
যানজটে আটকে পড়েছিল তৃণমূল নেতার মোটরবাইক। মোটরবাইক নিয়ে পাশ দিয়ে এগনোর সময় গুলি চালাল আততায়ী। লক্ষ্যভ্রষ্ট গুলি বিঁধল পাশের ভ্যানে বসা প্রতিবন্ধী শিক্ষিকার ডান পাঁজরের নীচে। অদিতি অধিকারী নামে ওই শিক্ষিকা আশঙ্কাজনক অবস্থায় কলকাতার পার্ক সার্কাসের একটি নার্সিংহোমে চিকিৎসাধীন।
সোমবার বেলা পৌনে ১১টা নাগাদ বনগাঁর উত্তর ছয়ঘড়িয়া মোড়ের কাছে, যশোহর রোডের উপরে এই হামলা অবশ্য এখানেই শেষ হয়নি। পুলিশ সূত্রের খবর, স্থানীয় তৃণমূল নেতা হুজুর আলি শেখ ছিলেন হামলাকারীদের লক্ষ্য। গুলির শব্দে চমকে গিয়ে মোটরবাইক থেকে পড়ে যান ওই তৃণমূল নেতা। তার পরে দৌড় মারেন। আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে হামলাকারীদের মধ্যে দু’জন তাড়া করে তাঁকে। এক জন গুলি চালালেও তা হুজুরের গায়ে লাগেনি। উল্টে দাঁড়িয়ে পড়ে তিনি তাদের এক জনের হাত থেকে আগ্নেয়াস্ত্র কেড়ে নেন। জনতাও জড়ো হতে থাকে। বেগতিক বুঝে তৃণমূল নেতার পিছু নেওয়া দু’জন তখন অন্য দিকে ছুটে পালায়। পালানোর সময় তাদের এক জন শূন্যে গুলি ছোড়ে। মোটরবাইকে পালায় তাদের আর এক সঙ্গী।
ঘটনার পরেই এলাকাবাসীদের একাংশ বনগাঁ থানায় গিয়ে দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্যের প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখান। কিছু স্থানীয় বাসিন্দা যশোহর রোড অবরোধ করেন। অবরোধ তুলতে গেলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। জনতার মারে জখম হন তিন পুলিশকর্মী। এক অফিসারের সোনার চেন লুঠ হয় বলে অভিযোগ। এলাকাবাসীর দাবি, পুলিশের মারে জখম হন তাঁদের কয়েকজন।
ইছা মণ্ডল এবং রাসেল মণ্ডল ওরফে বড়খোকা নামে দুই দুষ্কৃতীর বিরুদ্ধে বনগাঁ থানায় অভিযোগ জানান হুজুর। তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানান উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায়। পুলিশের উপরে হামলার আলাদা মামলা হয়েছে।
কিন্তু ওই তৃণমূল নেতার উপরে আক্রমণ হল কেন? হুজুর আলি শেখ এলাকায় প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা বলে পরিচিত। স্থানীয় ছয়ঘড়িয়া পঞ্চায়েতের এই প্রাক্তন সদস্যের দাবি, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে তাঁর আসনটি মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হয়ে যাওয়ায় ভোটে লড়েন তাঁর আত্মীয়া জোরিনা বিবি। জোরিনা হেরে যান সিপিএম প্রার্থীর কাছে। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোটের কিছু দিনের মধ্যে তাঁর স্বামী নাসির মণ্ডলকে বাড়ির গেটের সামনেই গুলি করে খুন করে আততায়ীরা। হুজুরের দাবি, “নাসিরকে সিপিএম-আশ্রিত দুষ্কৃতীরা খুন করে। আমি তাদের শাস্তির জন্য চেষ্টা করছিলাম। সেই রাগেই সিপিএম-আশ্রিত দুষ্কৃতীরা এ দিন আমার উপরে হামলা করে।”
সিপিএম অবশ্য অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। দলের ছয়ঘড়িয়া এলাকার নেতা গোবিন্দ মণ্ডল বলেন, “ঘটনার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নেই। ওই এলাকা এবং পেট্রাপোল স্থল-বন্দর এলাকায় দুষ্কৃতীদের মধ্যে পাচারের কারবারের দখল নিয়ে বিরোধের জেরে এই ঘটনা।” পুলিশের একটি সূত্রও জানাচ্ছে, গত কয়েক বছরে ছয়ঘড়িয়ায় দুষ্কৃতীদের মধ্যে চোরাচালানের ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের জেরে পর-পর কয়েকটি খুন হয়েছে। বছর তিনেক আগে পেট্রাপোলে খুন হন রশিদ মণ্ডল নামে এক স্থানীয় বাাসিন্দা। ওই ঘটনায় হুজুরের ছেলে সিন্টু শেখের নামে পুলিশের কাছে অভিযোগ হয়েছিল। জেলা পুলিশের একাংশের অনুমান, তার বদলা হিসাবেও এ দিন হামলা করা হয়ে থাকতে পারে। হুজুর অবশ্য বলেছেন, “আমার ছেলেকে খুনের মামলায় ফাঁসানো হয়। আমার উপরে হামলাও সে জন্য হয়নি।”
গুলিবিদ্ধ শিক্ষিকা অদিতিদেবীর বয়স বছর একত্রিশ। বাড়ি বনগাঁরই ট’বাজার এলাকায়। বছর দু’য়েক আগে হরিদাসপুর এলাকায় আনন্দমার্গ প্রাথমিক স্কুলে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ডান চোখে দৃষ্টি নেই তাঁর। হাসপাতালের পথে অদিতিদেবী বলেন, “ভ্যানে বসেছিলাম। হঠাৎ টায়ার ফাটার মতো শব্দ পেলাম। তার পরেই বুকে যন্ত্রণা শুরু হল। আর কিছু মনে নেই।”
জেলা পুলিশের এক কর্তা জানান, ছয়ঘড়িয়া এলাকায় দুষ্কৃতীদের দাপাদাপি নতুন ঘটনা নয়। অপরাধ করে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসা দুষ্কৃতীরা যেমন এই এলাকায় লুকিয়ে থাকে, স্থানীয় সমাজবিরোধীরাও মাঝেমধ্যেই অপরাধ করে পালায় বাংলাদেশে। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, এ দিনের হামলাকারীরা বাংলাদেশ থেকে এসেছিল। এলাকাবাসীর ক্ষোভ, পরিস্থিতি জেনেও বছরের পর বছর পুলিশ নিষ্ক্রিয়। অভিযোগ উড়িয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, “ওখানে পুলিশ নিয়মিত টহল দেয়। বাংলাদেশের লাগোয়া জায়গা বলে দুষ্কৃতীরা দ্রুত গা-ঢাকা দেওয়ার সুযোগ পায়।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy