Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

পিকনিকে গিয়ে আনন্দ-আশাভঙ্গ ইছামতী, ডাবুতে

বড়দিনে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী বসিরহাট মহকুমার টাকিতে ইছামতী ভ্রমণে ভিড় জমেছিল পর্যটকদের। তুলনায় কম হলেও ভিড় হয়েছিল বসিরহাট এবং বাদুড়িয়ার বিভিন্ন পার্কে। তবে পুলিশ-প্রশাসনের নাকের ডগায় তারস্বরে ‘ডিজে মাইক’-এর শব্দ তাণ্ডব সহ্য করতে রীতি মতো কাহিল অবস্থা হল স্থানীয় বাসিন্দাদের।

ডাবুতে তখন চলছে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব। ইনসেটে, চুরি হয়েছে কল।

ডাবুতে তখন চলছে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব। ইনসেটে, চুরি হয়েছে কল।

নির্মল বসু ও সামসুল হুদা
হাসনাবাদ ও ক্যানিং শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:৪৪
Share: Save:

বড়দিনে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী বসিরহাট মহকুমার টাকিতে ইছামতী ভ্রমণে ভিড় জমেছিল পর্যটকদের। তুলনায় কম হলেও ভিড় হয়েছিল বসিরহাট এবং বাদুড়িয়ার বিভিন্ন পার্কে। তবে পুলিশ-প্রশাসনের নাকের ডগায় তারস্বরে ‘ডিজে মাইক’-এর শব্দ তাণ্ডব সহ্য করতে রীতি মতো কাহিল অবস্থা হল স্থানীয় বাসিন্দাদের। চড়ুইভাতি করতে আসা মানুষের একাংশেরও ক্ষুব্ধ বক্তব্য, “একটু আনন্দ করতে বছরের বিশেষ দিনটি বেছে নেওয়া। কিন্তু যে ভাবে শব্দ তাণ্ডব শুরু হয়েছে, তাতে একে অপরের কথা শোনার বা একটু শান্তিতে ইছামতীর মনোরম সৌন্দর্য দেখার উপায় নেই। মাইকের শব্দ কমানোর বিষয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের কোনও উদ্যোগও নেই।”

অন্য বছরের তুলনায় এ বারের এই বিশেষ দিনে দূর-দূরান্ত থেকে বসিরহাট বা টাকির ইছামতী সংলগ্ন এলাকায় চড়ুইভাতি করতে আসা মানুষের সংখ্যা বেশ কম ছিল। কিন্তু পুরসভা কর্তৃপক্ষের তরফে অতিথিদের জন্য গাড়ি মজুত রাখার পাশাপাশি রাস্তা, পার্কে রঙবেরঙের আলো এবং ফোয়ারা লাগানো হয়েছিল। পিকনিকে আসা অনেক গাড়িতে দেখা গিয়েছে চার থেকে শুরু করে আটটি বা দশটি সাউন্ড বক্স তারস্বরে বাজানো হচ্ছে। পাশাপাশি বক্সের বিপুল শব্দ আবার মিলে মিশে, কার কী গান বাজছে তা-ও বোঝার উপায় নেই। শব্দের জ্বালায় কয়েকটি পিকনিকের দল ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ে।

টাকিতে ইছামতীর অন্য পারে বাংলাদেশের সাথক্ষিরা। নদীর ধারে গাছ-গাছালি ঘেরা ‘প্রতীপ সৈকতে’ বেশ কয়েকটি ছোট ছোট কটেজ তৈরি হয়েছে। সেখানে ‘ডিজে মাইক’ বাজিয়ে আনন্দে মেতেছিল কিছু ছেলে। টাকি গেস্ট হাউসের পাশে নারকেল গাছের সারির মাঝে ‘শচীন্দ্র বীথি’তেও ভ্রমন রসিক মানুষের ভিড় জমেছিল। পুরসভার উদ্যোগে দু’জায়গা থেকেই সীমান্তবর্তী নদীতে ঘোরার পাশাপাশি ‘মাছরাঙা দ্বীপ’ দেখার জন্য নৌকো, ভুটভুটি এবং লঞ্চের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। নদীর ধার ঘেঁসে গড়ে ওঠা একাধিক সরকারি ও বেসরকারি গেস্ট হাউসগুলিও ছিল ভিড়ে ঠাসা।

জালালপুর গ্রামে ইছামতীর গা ঘেঁসে প্রায় চার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সুন্দরবনের আদলে গরান, গোল, সুন্দরী-সহ নানা গাছ লাগিয়ে তৈরি জঙ্গল এবং ইকো পার্ক দেখতে বিকেলে রীতিমতো ভিড় জমে। কলকাতার বালিগঞ্জ থেকে আসা অপূর্ব মল্লিক, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজল সিংহ বলেন, “টাকিতে পিকনিক করতে আসার অন্যতম কারণ, ইছামতীর ধারে বসে বাংলাদেশের গন্ধ নেওয়া। কিন্তু যে রকম নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে মাইক বাজানো হচ্ছে, তাতে আনন্দের পরিবর্তে শব্দ দূষণের চোটে দ্রুত খাওয়া সেরে এলাকা ছাড়তে পারলে বাঁচি।” পর্যটকদের সুবিধার্থে যে ভাবে টাকি সাজানো হয়েছে, তেমন শব্দ দূষণের দিকটাতেও একটু লক্ষ রাখলে ভাল হত বলে তাঁরা মনে করেন।

টাকির তুলনায় ভিড় কম ছিল বসিরহাটের মির্জাপুরে ইছামতীর পাশে তৈরি শহিদ দীনেশ মজুমদার শিশুপার্ক এবং ইছামতী পিকনিক গার্ডেনে। এখানে বাঁশের লম্বা সাঁকো পেরিয়ে লম্বা লম্বা ঝাউ গাছের বাগানের মধ্যে বিচালির ছাউনি দেওয়া ঘরের সামনে পিকনিক করার আনন্দটাই অন্য রকম। রান্না করার আলাদা জায়গা, খেলার মাঠ, বাথরুম, স্নানের ব্যবস্থা বা গাড়ি পার্কিং-এর জায়গা অত্যন্ত সুষ্ঠু ভাবে পরিকল্পিত। চারধারে লম্বা খাল কাটা। এক সময়ে ঠিক হয়েছিল জলাশয় বাদ দিয়ে প্রায় তেষট্টি বিঘা ওই জমিতে পার্কটি আরও আকর্ষণীয় করতে উদ্যোগ করা হবে। রাত্রিবাসের জন্য পুর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে তৈরি হবে ট্যুরিস্ট লজ, কুমির প্রকল্প, ট্রয় ট্রেন, রোপওয়ে, সাইন্স পার্ক। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেই পরিকল্পনা আর এগোয়নি।

বাদুড়িয়ার তারাগুনিয়া গ্রামের পিকনিক স্পটটিও আকর্ষণীয় করতে বেশ কিছু উদ্যোগ করা হয়েছে। পশু-পাখি সহ দোলনা-স্লিপ, পুকুরে ময়ূরপঙ্খী, নৌকায় ভ্রমণের ব্যবস্থা রয়েছে। তৈরি করা হয়েছে ছোট ছোট কটেজও।

এ দিকে বড় দিনের উত্‌সবে সকাল থেকে ক্যানিং মহকুমার গির্জায় গির্জায় যখন চলছে প্রার্থনা, নানা অনুষ্ঠান। অন্য দিকে তখন বাস, ট্রেকার, ম্যাটাডোর, গাড়িতে সাউন্ড বক্স বাজিয়ে পর্যটকদের পিকনিকে বেরিয়ে পড়ার একই ছবি দেখা যায় এখানেও।

বাম আমলে ক্যানিংয়ের ডাবুতে প্রায় একশো চার একর জমির উপরে সেচ দফতরের ক্যানাল বিভাগ পিকনিক স্পট তৈরি করেছিল। সেচ দফতরের উদ্যোগে ওই জায়গায় ইউক্যালিপটাস, সোনাঝুরি, অর্জুন, শিরীষ, মেহগনি গাছ লাগিয়ে মনোরম পরিবেশ তৈরি করা হয়। প্রতি বছরই ভ্রমণ পিপাসুরা বছর শেষের এই সময়ে এখানে ভিড় জমান। কিন্তু এমন সুন্দর স্পটে পরিকাঠামোগত সমস্যা থাকায় পিকনিকে আসা পর্যটকেরা নানা সমস্যার সম্মুখীন হন। তাঁদের অভিযোগ, কলকাতার অদূরে সরকারি উদ্যোগে এত সুন্দর একটি স্পট থাকা সত্ত্বেও এখানে গড়ে তোলা হয়নি উপযুক্ত পরিকাঠামো।

এক সময়ে পর্যটকদের সুবিধার জন্য এখানে লাগানো হয়েছিল নলকূপ। পিকনিক স্পটটি কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা হয়েছিল। স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, সেচ দফতরের উদাসীনতায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ডাবুর পরিবাশ। সমাজবিরোধীদের আখড়া হয়ে ওঠায় রাতের অন্ধকারে গাছ কাটা তো চলছেই, পানীয় জলের নলকূপগুলি পর্যন্ত চুরি হয়ে গিয়েছে। কাঁটাতারের বেড়াগুলিও তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রশাসন যদি অবিলম্বে ব্যবস্থা না নেয়, কোনও গাছ আর অবশিষ্ট থাকবে না বলে দাবি স্থানীয় মানুষের।

সোদপুর থেকে এক দল তরুণ-তরুণী পিকনিক করতে এসেছিলেন। তাঁদের অভিযোগ, “সুন্দর পিকনিক স্পট হিসেবে ডাবুর নাম আমরা শুনেছিলাম। তাই এখানে আসা। কিন্তু এসে দেখলাম, এখানে জলের কোনও ব্যবস্থাই নেই। দু’একটি নলকূপ থাকলেও তা অকেজো। পুরুষ বা মহিলাদের জন্য শৌচালয়ের ব্যবস্থা নেই।” ডাবুতে কর্মরত ক্যানাল বিভাগের এক কর্মী বলেন, “রাতের অন্ধকারে সমাজবিরোধীদের আনাগোনা বাড়ছে। আমরা নিজেরাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।” তিনি আরও বলেন, “আগে এখানে ঢুকতে গেলে প্রবেশ মূল্য দিতে হত। কিন্তু পরিকাঠামো বেহাল হয়ে পড়ায় তা নেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে।”

এত সমস্যার মধ্যেও আমোদপ্রবণ মানুষ সারা দিন সেখানে পিকনিকের আনন্দে মেতে রইলেন। সারা দিন চলল বাংলা এবং হিন্দি গানের ফুলঝুরি। কোথাও বাজছে ‘হে ইউ লিসন টু মি, ইউ আর মাই লাভ জানো তুমি’ তো কোথাও ‘বচ্চন’-এর দাপট বা ‘ব্লু হ্যায় পানি পানি’। গানের তালে তালে চলছে নাচ। সকাল থেকেই ক্যানিং থানার সিভিক ভলান্টিয়ারেরা পর্যটকদের সুবিধার জন্য হাজির ছিলেন। পিকনিক স্পটের সমস্যা নিয়ে ক্যানাল বিভাগের এক ইঞ্জিনিয়ারকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE