Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

বন্ধ হতে বসা পুজোর দায়িত্ব নেন মহিলারা

পুজো বন্ধ হতে দেওয়া যাবে না— গ্রামের মহিলারা এককাট্টা ভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন কথাটা। সেটা প্রায় আট বছর আগের কথা। তত দিন ছেলেরাই পুজো করত গ্রামে। কিন্তু তাদের মধ্যে ঞঢুকে পড়ে রাজনীতির মারপ্যাঁচ। যার জেরে পুজোই বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়।

চাঁদা চাইতে বেরিয়ে মিলছে চাল-ডালও। —নিজস্ব চিত্র।

চাঁদা চাইতে বেরিয়ে মিলছে চাল-ডালও। —নিজস্ব চিত্র।

দিলীপ নস্কর
পাথরপ্রতিমা শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০১৫ ০০:৫২
Share: Save:

পুজো বন্ধ হতে দেওয়া যাবে না— গ্রামের মহিলারা এককাট্টা ভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন কথাটা।

সেটা প্রায় আট বছর আগের কথা। তত দিন ছেলেরাই পুজো করত গ্রামে। কিন্তু তাদের মধ্যে ঞঢুকে পড়ে রাজনীতির মারপ্যাঁচ। যার জেরে পুজোই বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়।

কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামে পুজোকে ঘিরে বহু মানুষের আবেগ জড়িয়ে। গ্রামে কার্যত বড় উৎসব বলতে এই পুজোই। তা ছাড়া, ওই এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দাদের কাকদ্বীপ, ডায়মন্ড হারবার বা কলকাতায় গিয়ে দেবীদর্শন করার মতো সাধ্যও নেই। ফলে উৎসব একেবারে বন্ধ হয়ে যাক, মেনে নিতে পারেননি মহিলারা। এগিয়ে আসেন তাঁরাই। দলমত নির্বিশেষে তৈরি হয় ‘মহিলা গোষ্ঠী’। বর্তমানে যার সদস্য সংখ্যা ৪০ জন। বয়স্ক মহিলা থেকে শুরু করে গৃহবধূ, স্কুলপড়ুয়া ছাত্রীরাও আছে কমিটিতে। তাঁরাই দুর্গা পুজোর দায়িত্ব নিয়েছেন। পাথরপ্রতিমার মৃদঙ্গভাঙা, পাখিনালা, ঠাকুরান ও আঠেরোগাছি— এই চারটি নদী ঘেরা আই-প্লট দ্বীপের অচিন্ত্যনগর পঞ্চায়েতের বিষ্ণুপুর গ্রামের মহিলাদের পুজো এ বার আট বছরে পড়ল।

ভোর ভোর উঠে ঘরের কাজ সামলে নিয়ে স্বামী, শ্বশুর-শাশু‌ড়ির কাছে বাড়ির বাচ্চাদের ছেড়ে বাড়ির মহিলারা বেরিয়ে প়ড়ছেন চাঁদা তোলার কাজে। পাথরপ্রতিমার অচিন্ত্যনগর পঞ্চায়েতে বিষ্ণুপুর গ্রামের মহিলারাই দুর্গা পুজার দায়িত্বে।

সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, গ্রামের ঠাকুরদালানের কাছে এক এক করে জড়ো হচ্ছেন ছবি মাটিয়া, রিনা মাটিয়া, জ্যোৎস্না মাইতি, মঞ্জুরি বাগ, অলোকা কর। জনা পনেরোর দল। ছোট তিন-চারটি দলে ভাগ হয়ে তাঁরাই বিল বই, খাতা-কলম নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন চাঁদা তোলার কাজে। চার-পাঁচ ঘণ্টা ধরে পড়শিদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাঁদা তুলে দুপুরে ফিরলেন বাড়িতে। চাঁদার টাকা রাখা রয়েছে কয়েকজনের কাছে। গ্রামে অনেক দুঃস্থ মানুষের বাস। তাঁদের থেকে চাঁদা চাওয়া হচ্ছে না। যে যেমন পারছেন চাল, ডাল, শাক-সব্জি দেবেন বলে জানালেন পুজো কমিটির সদস্যেরা। সেটাও নানা কাজে লাগবে পুজোয়।

পুজা চালানোর জন্য মাস খানেক আগে থেকে প্রতি শনি বা রবিবার প্রস্তুতি সভা ডাকা হয়। গ্রামেরই প্রাথমিক স্কুলের বারান্দায় বিকেল থেকে বসা ওই সভায় কমিটির সম্পাদক, সহ সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ ঠিক হয়।

এ বার পুজো কমিটির সম্পাদক হয়েছেন ছবি মাটিয়া। সহ সম্পাদক জ্যোৎস্না মাইতি। কোষাধ্যক্ষ বীথিকা মাইতি। সদস্যদের প্রত্যেককে ২০০ টাকা করে চাঁদা বরাদ্দ রয়েছে। আর ওই চাঁদার টাকা জোগাড় করতে অনেকেই অন্যের জমিতে দিনমজুরি করেন। কেই আবার ১০০ দিনের প্রকল্পের কাজ করে টাকা জমান অল্প অল্প করে।

দেখা গেল, স্কুলের মাঠের পাশে ত্রিপল ঢাকা ছাউনিতে প্রতিমা তৈরির কাজ চলছে। মণ্ডপ তৈরির কাজও চলছে জোর কদমে। মহিলারাই মাইক, জেনারেটর, ঢাকি ভাড়া করা থেকে প্রতিমা বিসর্জন— সব কাজ সামলান। তবে দিনে দিনে বাজার দর বেড়ে যাওয়ায় আর সে ভাবে চাঁদা না পেয়ে কিছুটা হতাশ তাঁরা। প্রায় ৬০-৭০ হাজার টাকার বাজেটের পুজো বলে কথা। সদস্যারা জানালেন, গ্রামের পড়শিদের বাড়ি বাড়ি গেলে কেউ ১০ টাকা, কেউ ২০ টাকা চাঁদা দিচ্ছেন। কেউ বা টাকা না দিয়ে ঘরের চাল-ডাল-শাক-সজ্বি দিচ্ছেন। পুজোর নানা কাজে যে সব কর্মীরা আসেন দূর দূরান্ত থেকে, তাঁদের খাবার বাবদ সে সব রেখে বাকিটা বিক্রি করে সেই টাকা পুজোর রকাজে লাগানো হয়। চাঁদা তুলতে নিজেদের গ্রাম ছাড়াও পাশাপাশি লক্ষ্মীপুর, কুমারপুর, পাথরপ্রতিমা, রামগঙ্গা, কেদারপুর, বিরাটবাজার, কে-প্লট এলাকায় বিভিন্ন বাজারে দল বেঁধে যান মহিলারা। এখনও পর্যন্ত প্রায় ১ কুইন্ট্যাল চাল চাঁদার বিনিময়ে পাওয়া গিয়েছে বলে জানালেন তাঁরা। আর পুজো মণ্ডপে সারা রাত পাহারায় থেকে ক’দিন ধরে নানা অনুষ্ঠান তাঁরা নিজেরাই করেন বলে জানা গেল।

ছবি মাটিয়া, জ্যোৎস্না মাইতিরা বললেন, ‘‘পুজোর দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করতে গিয়ে অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়। সব থেকে বড় সমস্যা টাকার জোগাড়। তবে যা-ই হোক, আমরা চাই গ্রামের পুজোতে রাজনীতি যেন না ঢোকে।’’ তবে পরিস্থিতি যেমনই হোক, পুজো নিয়ে উৎসাহের অভাব নেই কারও। গোষ্ঠীর কনিষ্ঠতম সদস্য উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী লক্ষ্মী মাইতির শুধু আফসোস, ‘‘গ্রামের যাতায়াতের ইট-পাতা রাস্তাটা যদি পিচের হতো, তা হলে আমরাও শহরের মতো রাস্তা জুড়ে আলপনা আঁকতে পারতাম।’’

এলাকার বাসিন্দা তথা পাথরপ্রতিমা পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূলের পূর্ত কর্মাধক্ষ্য রজনীকান্ত বেরা পুজো কমিটির আর্থিক সমস্যার কথা বোঝেন। বললেন, ‘‘পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষরাই ওই পুজোয় বাধা হয়ে উঠেছে। মহিলারা কোনও রকমে চেয়েচিন্তে পুজোর খরচ জোগাড় করেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE