Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

বহু জায়গায় ছাপ্পার অভিযোগ, এমন নির্বাচন আগে কখনও দেখেনি বনগাঁ

শনিবার বেলা দেড়টা। পুলিশের কাছে খবর এল বনগাঁ পুরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে নিউ বনগাঁ হাইস্কুলের বুথে বহিরাগতরা জড়ো হয়ে ছাপ্পা দেওয়ার চেষ্টা করছে। ওই খবর পেয়ে বনগাঁর এসডিপিও বিশ্বজিৎ মাহাতো বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে ওই স্কুলের দিকে রওনা হয়ে গেলেন। এসডিপিও এত ক্ষণ ছিলেন ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে বনগাঁ হাইস্কুলের বুথে।

উত্তেজনার পারদ: কিছু ক্ষেত্রে পুলিশের এই সক্রিয়তা সত্ত্বেও উঠল নানা অভিযোগ। শনিবার বনগাঁর ৫ নম্বর ওয়ার্ডে নির্মাল্য প্রামাণিকের তোলা ছবি।

উত্তেজনার পারদ: কিছু ক্ষেত্রে পুলিশের এই সক্রিয়তা সত্ত্বেও উঠল নানা অভিযোগ। শনিবার বনগাঁর ৫ নম্বর ওয়ার্ডে নির্মাল্য প্রামাণিকের তোলা ছবি।

সীমান্ত মৈত্র
বনগাঁ শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৫ ০০:৫৪
Share: Save:

শনিবার বেলা দেড়টা। পুলিশের কাছে খবর এল বনগাঁ পুরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে নিউ বনগাঁ হাইস্কুলের বুথে বহিরাগতরা জড়ো হয়ে ছাপ্পা দেওয়ার চেষ্টা করছে। ওই খবর পেয়ে বনগাঁর এসডিপিও বিশ্বজিৎ মাহাতো বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে ওই স্কুলের দিকে রওনা হয়ে গেলেন। এসডিপিও এত ক্ষণ ছিলেন ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে বনগাঁ হাইস্কুলের বুথে।

পুলিশবাহিনী বনগাঁ হাইস্কুল থেকে রওনা হতেই সেখানে ঢুকে পড়ল জনা চল্লিশ বহিরাগত। তাদের সঙ্গে কিছু স্থানীয় লোকজনও। ঢুকেই তারা প্রথমে বনগাঁ হাইস্কুলের গেট বন্ধ করে দিল। ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম প্রার্থীর স্বামী তথা তাঁর নির্বাচনী এজেন্ট মদন ঘোষ তখন বুথের মধ্যেই ছিলেন। অভিযোগ, শাসক দলের ওই বহিরাগতরা মদনবাবুকে আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে স্কুলের সাইকেল রাখার ছাউনির নীচে নিয়ে যায়। কয়েক জন তাকে ঘিরে রাখে। মদনবাবু বলেন, ‘‘যারা ঘিরে রেখেছিল, তারা আমার মোবাইলটা প্রথমেই কেড়ে নেয়। হুমকি দিয়ে বলে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবি। ফোন করার কোনও চেষ্টা করবি না। আমাদের দলের দু’এক জন না বুঝে প্রতিবাদ করতে আসছিল। আমিই তাদের চলে যেতে বলি।’’

তত ক্ষণে বহিরাগতরা বুথে ঢুকে সিপিএম-বিজেপির এজেন্টদের তাড়িয়ে দিয়েছে। ভোট দিতে তখন লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন জনা পঞ্চাশ মানুষ। তাঁরাও ভয়ে পালিয়ে বুথ ছেড়ে চলে যান। প্রিজাইডিং অফিসার প্রাথমিক অবস্থায় আপত্তি জানালেও হুমকির কাছে শেষে তিনি চুপ করে যান বলে অভিযোগ। বুথে থাকা পুলিশ তখন উধাও। এরপরে শুরু হয় খুল্লামখুল্লা ছাপ্পা। মদনবাবু বলেন, ‘‘আমার ঘাড় উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রায় আধ ঘণ্টা অপারেশন চালিয়ে ওরা ফিরে যায়। যাওয়ার আগে বলে যায়, তুমি কিছুই দেখোনি। ভয়ে আমিও সে কথাই বলতে বাধ্য হই।’’ ঘটনার কিছু ক্ষণ পরে এসডিপিও ফিরে এলেও তত ক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে।

১৩ নম্বর ওয়ার্ডের এই পরিস্থিতি বিচ্ছিন্ন ঘটনা একেবারেই নয় বনগাঁয়। শনিবার তৃণমূলের পক্ষ থেকে ১, ১৩, ৫, ৮-সহ কয়েকটি ওয়ার্ডে বহিরাগতদের দিয়ে অবাধে ছাপ্পা দিয়েছে বলে বাম শিবির ও সাধারণ মানুষের অভিযোগ।

এক মহিলা বলেন, ‘‘ভোট দিতে ঢুকেছি। হাতে কালি লাগিয়ে ইভিএমের দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ এক বহিরাগত মুখ উঁচিয়ে হুমকির সুরে বলল, দিদি ভোটটা তৃণমূলেই দেবেন কিন্তু। আমি তখন না পেরে বলেই ফেলি, তা হলে ভোটটা তোমরাই দিয়ে দিও। মুখ দেখে কথাটা বলা তখনও শেষ হয়নি। ওই যুবক আমার চোখের সামনে আমার ভোটটা দিয়ে দিল। আমি ভাবতেই পারছি না আমি কেন ভোট দিতে গিয়েছিলাম।মানুষের উপর কী ওদের কোনও ভরসা নেই!’’

বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে বিরোধী এজেন্টদের ভয় দেখিয়ে বের করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অনেক তৃণমূল সমর্থকও নিজেদের ভোট নিজেরা দিতে পারেননি বলে জানা গেল। এক তৃণমূল সমর্থকের দাবি, ‘‘আমি আঙুলে কালি লাগিয়েছি। বোতাম টিপতে যাব, এমন সময়ে আমার পরিচিতরাই জানাল, তোর ভোট দিতে হবে না। আমরা দিয়ে দিচ্ছি। আমি বললাম, আমাকেও কি বিশ্বাস হচ্ছে না? ওরা বলল, বেশি কথা বাড়াস না।’’ ৫ নম্বর ওয়ার্ডে বহিরাগতদের হঠাতে পুলিশকে ব্যাপক লাঠি চালাতে হয়েছে। এখানেও শেষ মুহূর্তে ছাপ্পা চলেছে বলে অভিযোগ।

বিরোধী দলের নেতারা তো বটেই, বনগাঁ বহু সাধারণ মানুষ জানালেন, বনগাঁ পুরসভা ভোটের ইতিহাসে ছাপ্পা ভোট তাঁরা দেখেননি। বাসিন্দারা জানালেন, ‘‘যেহেতু এখানে বিরোধীরা দুর্বল, তারা প্রতিরোধ করতে পারেননি বা করতে যাননি। এ কারণেই কোনও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। বোমা-গুলি না চালিয়ে নীরবে বুথ দখল করে ছাপ্পা কী ভাবে করতে হয়, এ বারের পুরভোটে বনগাঁ তার নজির হয়ে থাকল।’’ এক যুবক ভোট দিতে গিয়ে ছাপ্পার প্রতিবাদ করায় তাঁকে ধাক্কাধাকি দিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছে। সেই যুবকের কথায়, ‘‘পরিচিত মানুষেরাও দেখলাম অচেনা হয়ে গিয়েছে। এমন রাজনৈতিক সংস্কৃতি বনগাঁয় ছিল না।’’

এক পুলিশ অফিসারের কথায়, ‘‘আমরা যখনই খবর পেয়েছি, ছুটে গিয়েছি। বিরোধী এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে, এমন খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে তাঁদের নিরাপত্তা দিতে চেয়েছি। কিন্তু ওঁরা নিজেরাই আর বসতে চাননি। বিরোধীরা আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করলে আরও শক্ত হাতে ভোট পর্ব চালানো যেত।’’

বনগাঁ হাইস্কুলের ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পরে অবশ্য পুলিশ অতি সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল। লাঠিচালানো, মার কিছুই বাদ দেয়নি তারা। পুলিশের মারে জখমও হয়েছে কয়েক জন। কিন্তু তত ক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে।

কিন্তু কেন ছাপ্পা দিতে হল তৃণমূলকে? এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘দলীয় ভাবে ছাপ্পা দেওয়া হয়নি। হলে সব ক’টি ওয়ার্ডেই হত। দু’একটি ওয়ার্ডে স্থানীয় ভাবে করা হয়ে থাকতে পারে। যার সঙ্গে দলের লাইনের কোনও সম্পর্ক নেই।’’ যে ওয়ার্ডগুলিতে ছাপ্পার নালিশ উঠেছে, সেগুলি গত পুরভোটে সিপিএমের দখলে ছিল। ফলে কমবেশি কিছুটা জনভিত্তি সিপিএমের ওয়ার্ডগুলিতে আছে। যে কারণে কোনও ঝুঁকি নিতে চায়নি বিরোধীশূন্য পুরবোর্ড গড়ার লক্ষে এগিয়ে যাওয়া তৃণমূল।

পাশাপাশি বিরোধীরা এতটাই প্রতিরোধহীন ছিলেন যে ছাপ্পা দেওয়ার কাজটা অনেকটাই সহজ হয়ে গিয়েছে। সিপিএমের নেতাদের বলতে শোনা গিয়েছে, এজেন্টরা কী করছে? তারা কেন বুথ ছাড়ছে? প্রয়োজনে মারধর খাক। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সিপিএমের দুর্বল সংগঠনের ফয়দা শাসক দল নিয়েছে বলেই রাজনৈতিক মহল মনে করছে।

শহর কংগ্রেস সভাপতি কৃষ্ণপদ চন্দ বলেন, ‘‘বনগাঁ শহরে ভোটে এমন ছাপ্পা আমার জীবদ্দশায় দেখিনি।’’ বনগাঁর প্রাক্তন বিধায়ক সিপিএমের পঙ্কজ ঘোষ জানিয়েছেন, নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছে। আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে ভয় দেখিয়ে, টাকা ছড়িয়েও তৃণমূল মানুষের উপরে ভরসা রাখতে পারেনি। দুষ্কতীরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। বনগাঁর রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন কলঙ্কজনক ঘটনা আগে ঘটেনি।’’ বিজেপি নেতা মধুসূদন মণ্ডল বলেন, ‘‘আমাদের এজেন্টদের জোর করে বের করে দিয়ে ছাপ্পা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।’’

শাসক দলের পক্ষ থেকে অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। বনগাঁ শহর তৃণমূল সভাপতি শঙ্কর আঢ্য বলেন, ‘‘পর্যবেক্ষক ছিলেন। এসডিপিও সব সময়ে টহল দিয়েছেন। তিনি ১ নম্বর ওয়ার্ডে তিন বার এসেছেন। কই তিনি তো ছাপ্পার অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পাননি। আসলে সিপিএম-সহ বিরোধীদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছে। তা বুঝতে পেরেই এখন ছাপ্পার গল্প তৈরি করছে।’’ পুলিশের ভূমিকা নিরপেক্ষ ছিল বলেই মনে করেন শঙ্করবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘৮ নম্বর ওয়ার্ডে পুলিশ আমাদের বুথ ভেঙে দিয়েছে। এ ছাড়া, কিছু ওয়ার্ডে পুলিশ তৃণমূল কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে।’’

বনগাঁর মহকুমাশাসক সুদীপ মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ছাপ্পা বা অন্য গোলমালের অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে পুলিশ পাঠানো হয়েছিল। কিছু কিছু জায়গায় আমি নিজেও গিয়েছিলাম।

কিন্তু তারপরেও উঠছে অভিযোগের পাহাড়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE