Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ভেড়ির টাকা আর গ্রাম দখলের লোভে বার বার রক্তাক্ত মিনাখাঁ

গত চার বছরে অন্তত পাঁচ জন খুন হয়ে গিয়েছে। দশ বছরের হিসেব ধরলে সংখ্যাটা ১২-১৬ জনে গিয়ে পৌঁছবে। আর ছোটখাট মারপিট, ঘর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, বোমা-গুলি চলার তো ইয়ত্তা নেই। গ্রামের লোকও এখন সেই সংখ্যাটা মনে রাখতে পারেন না।

জলমগ্ন স্কুল চত্বর।

জলমগ্ন স্কুল চত্বর।

নির্মল বসু
মিনাখাঁ শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৫ ০১:৪১
Share: Save:

গত চার বছরে অন্তত পাঁচ জন খুন হয়ে গিয়েছে। দশ বছরের হিসেব ধরলে সংখ্যাটা ১২-১৬ জনে গিয়ে পৌঁছবে। আর ছোটখাট মারপিট, ঘর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, বোমা-গুলি চলার তো ইয়ত্তা নেই। গ্রামের লোকও এখন সেই সংখ্যাটা মনে রাখতে পারেন না।

এলাকাটি উত্তর ২৪ পরগনার মিনাখাঁ। এখানকারই ধুতুরদহ পঞ্চায়েতের দক্ষিণ বারগা গ্রামে মঙ্গলবার গুলিতে নিহত হয়েছেন আরও এক জন, আবুবক্কর কয়াল। যাঁর রাজনৈতিক পরিচয়, সিপিএম কর্মী। এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এর আগেও যাঁরা খুন হয়েছেন, প্রত্যেকেরই কোনও না কোনও রাজনৈতিক পরিচয় আছে। একটা সময় ছিল বামেদের রমরমা। এখন ভোল বদলে অনেকেই তৃণমূলে। রাজনৈতিক ক্ষমতাও তৃণমূলের হাতে।

কিন্তু খুন-হিংসা, রাজনৈতিক সন্ত্রাসের এই আবহে গ্রামের উন্নয়নের কী হাল? মঙ্গলবার এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, চিত্রটা নেহাতই হতাশাজনক। পাকা রাস্তাঘাট বলে কিছু নেই। একটি স্কুল ভাল হলেও বাকিগুলির ভবন জীর্ণ। বিদ্যুৎ আসেনি অনেক জায়গায়। যে কারণে গ্রামের কয়েক জন মহিলাকে বলতে শোনা গেল, ‘‘গ্রামের উন্নয়ন নিয়ে কেউ কখনওই একমত হয় না। সে কারণে কোনও উন্নয়নও নেই। শুধু রাজনৈতিক নেতাদের কথা মতো ওরা নিজেদের মধ্যে মারপিট করে।’’ এ সব কথা বলার পরে কেউ নিজেদের পরিচয় দিলেন না, বলাইবাহুল্য।

এলাকাটির ভৌগোলিক অবস্থানের জন্যও দুষ্কৃতীদের বাড়বাড়ন্ত, এমনটা মনে করে পুলিশও। জায়গাটি উত্তর ২৪ পরগনা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার সীমান্তবর্তী। কাছেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার জীবনতলা থানার কালীকাতলা। মিনাখাঁ ও সন্দেশখালির মধ্যে দিয়েছে একটি খাল। যে কোনও দুষ্কর্ম ঘটিয়ে অপরাধীরা পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে এ দিক ও দিক পালিয়ে যেতে পারে সহজেই।

এ ছাড়াও মিনাঁখার এই অংশে বেশ কিছু মেছো ভেড়ি আছে। যেখানকার কাঁচা টাকার হাতছানি দুষ্কৃতীদের টেনে আনে। আর টাকার বখরা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যেও হানাহানি লেগে থাকে।


এই হাল গ্রামের পথঘাটের।

ধুতুরদহ পঞ্চায়েতে আসন সংখ্যা ১৩। যার মধ্যে ৬টিতে জিতে ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল। তার আগে বহু বছর ক্ষমতা ছিল সিপিএমের হাতে। এখন পঞ্চায়েতে তাদের আসন সংখ্যা ৫টি। নির্দলের টিকিটে জয়ী হয়েছিলেন দু’জন। ভোটারের সংখ্যা প্রায় ১৪০০।

গ্রামের দাপুটে সিপিএম নেতা বলে পরিচিত সওকত মোল্লা ওরফে হাসা। কয়েক মাস আগে গাঁজা পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন তিনি। গত কয়েক বছরে তাঁর দুই ভাই ও এক ভাইপো খুন হয়েছেন। তৃণমূল নেতা নূর আহমেদের ছেলে সাজাহান খুন হন বছর দেড়েক আগে।

ওই খুনের ঘটনার পর থেকে গ্রামে উত্তেজনা আরও বাড়ে। সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের বেশ কয়েকটি বাড়িতে ভাঙচুর চালানোর অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। যে ঘটনায় নাম জড়ায় তৃণমূলের ডাকসাইটে নেতা মনসুর মোল্লার বিরুদ্ধে। তাঁর কাছেই সিপিএমের লোকজন মঙ্গলবার হাসাকে নিয়ে ত্রাণ চাইতে গিয়েছিলেন বলে দাবি সিপিএমের। যাঁদের বাড়িঘর ভাঙার ঘটনায় আবার অভিযোগের তির মনসুরের দিকে।

সে কথা মনসুর মানেন না বলাইবাহুল্য। কিন্তু এটা ঠিক যে গত বছর দেড়েক এলাকার বেশ কিছু সিপিএম পরিবার ঘরছাড়া। সেই পক্ষে আছে সিপিএম নেতা হাসার লোকজন। তাঁরাই কিছু দিন ধরে গ্রামে ফিরতে চাইছিলেন। সিপিএমের একটি অংশ জানাচ্ছে, মনসুরের সম্মতি ছাড়া গ্রামে ঢোকা যাবে না, এটাও ঠিক।

এ দিন গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, দক্ষিণ বারগা গোপালপুর প্রাথমিক স্কুলের সামনে জলমগ্ন। গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টির জেরে স্কুল বন্ধ। সেখানেই এক কোণে আশ্রয় নিয়েছে কিছু পরিবার। রাজনৈতিক সন্ত্রাসের জেরে যাঁদের ঘরদোর ভেঙেছিল।

গুলিতে নিহত আবুবক্করের দেহ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল তৃণমূল কর্মী আজিজুল মোল্লার বাড়ির সামনে পুকুরের ধারে। তাঁর বাড়ির বারান্দার সামনে পড়েছিল রক্ত। আবুর বুকে গুলি লেগেছে। আজিজুলের স্ত্রী তাজমিরা বিবি বলেন, ‘‘মনসুরের বাড়ির সামনে গণ্ডগোল হচ্ছিল। নাগাড়ে গুলি চলছিল। অনেকে ছোটাছুটি করছিল। সিপিএমের লোকজন মারধর করছিল। আমার স্বামী ঘরে এসে লুকিয়ে পড়েন। কী হচ্ছে দেখতে আমি বেরিয়েছিলাম বাড়ির বাইরে। ফেরার সময়ে দেখি বারান্দার সামনে রক্ত পড়ে। পুকুরের পাশেই পড়েছিল আবুর দেহ।’’

তৃণমূল নেতা নূর আহমেদের আত্মীয়া নব্বই বছরের আছিয়া বেওয়া বললেন, ‘‘মাঝে মাঝেই গ্রামে গোলমাল, মারপিট হয়। এই তো ক’দিন আগে আমার নাতিকে ওরা খুন করে গেল। এ দিনও গুলি চলছিল। মারপিট বেধেছিল দু’পক্ষের। আমার সামনেই গুলি এসে লাগে একজনের গায়ে।’’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৃদ্ধা বলেন, ‘‘গ্রামটার যে কী হয়েছে, শুধুই খুনোখুনি!’’

এই গোলাগুলির ইতিহাস সহজে থামবে নাে মিনাখাঁয়। তা বিলক্ষণ জানেন রাজনৈতিক দলের নেতারা।

সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য মৃণাল চক্রবর্তী বলেন, ‘‘ওই এলাকার একটি অংশ দুষ্কৃতী-প্রবণ। এলাকার উন্নয়ন নিয়ে উদ্যোগের অভাব আছে স্থানীয় মানুষেরই। তা ছাড়াও, এলাকাটি দুর্গম হওয়ায় বাড়তিও সমস্যাও আছে।’’

অন্য দিকে, ধুতুরদহ পঞ্চায়েতের প্রধান তৃণমূলের রিয়াজুল দফাদার বলেন, ‘‘বাম আমলে এখানে কোনও উন্নয়ন হয়নি। আমরা সামান্য কিছু দিন হল ক্ষমতায় এসেছি। তা-ও যতটুকু কাজ করতে পেরেছি, তাতে পুলিশের গাড়ি অন্তত গ্রাম পর্যন্ত আসতে পারে। আগে তা-ও পারত না।’’ উন্নয়ন নিয়ে স্থানীয় মানুষের সহযোগিতা মেলে না বলেও তাঁর অভিযোগ। এলাকার কিছু পরিবার গোলমালের করাটাকে এক রকম অভ্যাসের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে বলে কটাক্ষ প্রধানের।

রাজনীতির কারবারিরা রাজনীতির কথাই বলবেন। কিন্তু গ্রামের উন্নয়ন হবে কী ভাবে, শান্তি ফিরবে কবে, এ সব প্রশ্নই শুধু ঘুরপাক খাবে মিনাখাঁয়— এমনটাই ধরে নিয়েছেন এখানকার সাধারণ মানুষ।

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE