Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

৯২ কিলোমিটার রেলপথে বরাদ্দ ৩০ জন পুলিশ

গুমা-বামনগাছি রেললাইনের দু’পাশে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা কার্যত দুষ্কৃতীদের আঁতুরঘর। সাট্টা-জুয়া-মদের আসর বসে নিয়মিত। খুন-জখমের ঘটনাও ঘটে। চোখ রাখল আনন্দবাজার। আজ শেষ কিস্তি।পুলিশের নজরদারির অভাবেই রেলপাড় এলাকা দুষ্কৃতীদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ স্থানীয় মানুষের। রেলবস্তি এলাকার বাসিন্দারাই শুধু এই সব এলাকায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তা নয়, বাইরে থেকেও দুষ্কৃতীরা জড়ো হয় এই সব এলাকায়। রেললাইনের ধারে দিনে-রাতে কখনওই পুলিশি টহল দেখা যায় না বলে জানালেন তাঁরা। যদি বা দেখা যায়, তারা আসে তোলা নিতে। শ্যামল যে এলাকায় আড্ডা দিত তার পাশেই কিছু দিন আগে একটি মেয়ের মৃতদেহ উদ্ধার হয়।

বিড়া ও গুমার মাঝে এখানেই খুন করে ফেলে রাখা হয়েছিল গৌতমের দেহ। নিজস্ব চিত্র।

বিড়া ও গুমার মাঝে এখানেই খুন করে ফেলে রাখা হয়েছিল গৌতমের দেহ। নিজস্ব চিত্র।

সীমান্ত মৈত্র
বনগাঁ শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৪ ০০:১৭
Share: Save:

পুলিশের নজরদারির অভাবেই রেলপাড় এলাকা দুষ্কৃতীদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ স্থানীয় মানুষের। রেলবস্তি এলাকার বাসিন্দারাই শুধু এই সব এলাকায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তা নয়, বাইরে থেকেও দুষ্কৃতীরা জড়ো হয় এই সব এলাকায়। রেললাইনের ধারে দিনে-রাতে কখনওই পুলিশি টহল দেখা যায় না বলে জানালেন তাঁরা। যদি বা দেখা যায়, তারা আসে তোলা নিতে। শ্যামল যে এলাকায় আড্ডা দিত তার পাশেই কিছু দিন আগে একটি মেয়ের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। মাস তিনেক আগে এক যুবকের বস্তা-বন্দি দেহও পাওয়া গিয়েছিল।

রেল পুলিশের তরফে এ ক্ষেত্রে পরিকাঠামোগত সমস্যার কথা বলা হয়েছে। বনগাঁ জিআরপির অধীনে রয়েছে বনগাঁ-শিয়ালদহ ও বনগাঁ-রানাঘাট লাইনের মোট ২১টি স্টেশন। এলাকার হিসাবে ৯২ কিলোমিটার। কিন্তু বিস্তীর্ণ এই অংশে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আছেন মাত্র ৩০ জনের মতো পুলিশ কর্মী। এই সংখ্যক পুলিশ নিয়ে প্রতিটি স্টেশনে টহল দেওয়া যে কার্যত অসম্ভব, তা মেনে নিচ্ছেন রেল পুলিশের কর্তারাই। তা ছাড়াও আছে দৈনন্দিন আরও কিছু কাজ। যেমন আদালতে সাক্ষ্য দিতে যাওয়া বা ‘ভিআইপি ডিউটি’। সে জন্যও প্রতি দিনই কিছু না কিছু ব্যস্ত থাকতে হয় রেল পুলিশকে। রেল পুলিশের এক অফিসারের কথায়, “ইচ্ছে থাকলেও আমাদের উপায় থাকে না। পুলিশ কর্মী যে কম, সে খবর রাখে দুষ্কৃতীরাও। রাজ্য পুলিশের তুলনায় ধরপাকড় কম হবে, পালিয়ে যাওয়া সহজ— এ সব মাথায় রেখেও তারা রেলপাড় এলাকায় দৌরাত্ম্য চালিয়ে যাওয়ার সাহস পায়।” তবে রেল পুলিশকে অনেক ক্ষেত্রে তদন্ত চালাতে সাহায্য করে রাজ্য পুলিশ। উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, “জিআরপির সঙ্গে আমরা যৌথ তল্লাশি করে থাকি। রেল পুলিশের এলাকায় নিয়মিত অভিযান চালাই আমরাও।” তোলাবাজির অভিযোগ মানতে চায়নি রেল পুলিশ, রাজ্য পুলিশ কোনও পক্ষই। পুলিশের একাংশের আবার বক্তব্য, চোলাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযান নিয়ে শুধু পুলিশকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো ঠিক নয়। আবগারি দফতর কী করছে, সে দিকেও নজর রাখা উচিত।

বাসিন্দাদের অভিযোগ, বেলতলা এলাকায় চোলাই বিক্রি ও জুয়ার ঠেক চললেও পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয় না। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “রোজ এক-দেড় লক্ষ টাকার জুয়ার বোর্ড বসে এখানে। বাইরে থেকে দুষ্কৃতীরা খেলতে আসে।” এলাকার এক প্রবীন বাসিন্দা জানালেন, বেলতলাকে দ্বিতীয় বামনগাছি বলা যেতেই পারে। পাশেই ছোট বামনিয়া গ্রামের মানুষ রেলপাড় দিয়ে যাতায়াত করেন। তাতে তাদের দূরত্ব কমে। কিন্তু রাতে তারা খুব প্রয়োজন ছাড়া এই পথ মাড়ান না কেউই। দিন কয়েক আগেই সন্ধায় এই পথ দিয়ে এক মহিলা বাড়ি ফিরছিলেন। তাঁর পিছু নিয়ে এক দুষ্কৃতী বাড়ি গিয়ে চড়াও হয়। মহিলাকে ধর্ষণ করা হল বলেও অভিযোগ উঠেছে। রাতে মহিলাদের কটূত্তি করা হয়। টাকা-পয়সা কেড়ে নেওয়ার ঘটনা আকছার ঘটে। আশিস, গৌতম, ময়দা মদন— এই সব দুস্কৃতীরা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেল। ডাকাতি বা খুন করে রেলবস্তিতে আত্মগোপন করে থাকে দুষ্কৃতীরা।

কিছু দিন আগে অশোকনগর রেল স্টেশনে এক যুবকে গুলি করে খুন করা হয়েছে। এলাকার মানুষের দাবি, দুষ্কৃতীদের বাড়বাড়ন্তের পিছনে রয়েছে রাজনৈতিক দলের কোনও কোনও নেতার মদত। সাম্প্রতিক সময়ে নানা ঘটনায় তোতা, রাম, রাজু, নীলু, খোকন, মদন, স্বপন, গণেশ, শুভঙ্করের মতো দুষ্কৃতীরা পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও রেলপাড়ের পরিস্থিতি যে কে সেই।

অশোকনগরের প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক সত্যসেবী কর বলেন, “রেলপাড়ে যে সমাজবিরোধীরা আশ্রয় নিচ্ছে, তা শাসকদলের মদতেই। সব জেনেশুনেও পুলিশ-প্রশাসন নির্বিকার। অবিলম্বে সব দুস্কৃতীকে গ্রেফতার করতে হবে। তা না হলে আরও কত প্রাণ চলে যাবে, কে জানে।”

অশোকনগরের তৃণমূল বিধায়ক ধীমান রায় বলেন, “গুমা থেকে বিড়া রেলপাড় এলাকায় তিনটি থানা পড়ে। অশোকনগর, দত্তপুকুর ও আমডাঙা। অশোকনগর থানা মাঝে মধ্যেই চোলাই-সাট্টার বিরুদ্ধে অভিযান চালায়।” সিপিএম বিধায়কের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাঁর পাল্টা অভিযোগ, জামাল মল্লিক নামে সিপিএম আশ্রিত এক দুষ্কৃতীই রেলপাড়ের অসামাজিক কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করে। সে এখন জেলে। কিন্তু তার সাদরেগরাই অপরাধ জগত শাসন করছে।

রাজনৈতিক চাপানউতোর চলবেই। কিন্তু সমস্যার সুরাহা কবে হবে, তা জানে না কেউই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE