Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

গরু-বোঝাই ট্রাকের দাপট রাতের যশোহর রোডে

দিনের বেলা মূল সমস্যা যানজটের। রাতে যানজটহীন ফাঁকা যশোহর রোড আবার অন্য চেহারা। সংকীর্ণ সড়ক ধরে বেপরোয়া ভাবে চলে পাচারের গরু-বোঝাই ট্রাক। পেট্রাপোল বন্দর থেকেও ট্রাকের যাতায়াত লেগে থাকে। একই সঙ্গে ছোট-বড় নানা গাড়ি রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রাস্তার ধারে মাঝে মধ্যেই ট্রাকের সারি। বহু নম্বরপ্লেটহীন ট্রাক, বাইক চোখে পড়বে। মোটরবাইকে হেলমেট পরার তো রেওয়াজই নেই।

নম্বর প্লেটহীন মোটর বাইক।

নম্বর প্লেটহীন মোটর বাইক।

সীমান্ত মৈত্র
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:৪২
Share: Save:

দিনের বেলা মূল সমস্যা যানজটের। রাতে যানজটহীন ফাঁকা যশোহর রোড আবার অন্য চেহারা। সংকীর্ণ সড়ক ধরে বেপরোয়া ভাবে চলে পাচারের গরু-বোঝাই ট্রাক। পেট্রাপোল বন্দর থেকেও ট্রাকের যাতায়াত লেগে থাকে। একই সঙ্গে ছোট-বড় নানা গাড়ি রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রাস্তার ধারে মাঝে মধ্যেই ট্রাকের সারি। বহু নম্বরপ্লেটহীন ট্রাক, বাইক চোখে পড়বে। মোটরবাইকে হেলমেট পরার তো রেওয়াজই নেই। চালকের মাথায় যদি বা হেলমেট ওঠে, পিছনে বসা সঙ্গীর সে সবের বালাই নেই। রাস্তার বহু অংশে আলো নেই। পর্যাপ্ত পুলিশি টহলও চোখে পড়ে না। নিরাপত্তারক্ষীহীন এটিএম কাউন্টার। রাস্তার ধারে পানশালার বাইরে মদ্যপদের হল্লা বারাসতের পর থেকে বনগাঁ পর্যন্ত ৩৫ নম্বর জাতীয় সড়কের নিশি-চিত্র এমনটাই।

এই সড়ক কার্যত সারা রাতই জেগে। প্রচুর গাড়ি চললেও বেশির ভাগ পেট্রলপাম্প বন্ধ থাকে। কয়েকটি ছোটখাট ধাবা, হোটেল খোলা দেখা গেল। দু’একটি ধাবায় রাস্তার ধারে বসেই মদ্যপান চলতে দেখা গেল। ট্রাক চালকদের অনেকেই রাতে এ সব জায়গায় মদ্যপান করে সেই অবস্থায় গাড়ি চালান বলে অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। কিন্তু ব্যবস্থা নেবে কে? ফলে দ্রুত গতির বেপরোয়া ট্রাকের দাপাদাপি চলে গোটা রাতজুড়ে।

বনগাঁ থেকে বামনগাছি প্রায় ৫০ কিলোমিটার। সোমবার রাতে ওই পথের নানা অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে বেরিয়ে পড়েছিলাম। সঙ্গী চিত্রসাংবাদিক নির্মাল্য প্রামাণিক। রাত সাড়ে ১২টায় বামনগাছি মোড় থেকে গাড়িতে রওনা হলাম বনগাঁর দিকে। সেই বামনগাছি মোড়, যেখান থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে থাকতেন সৌরভ চৌধুরী। দুষ্কৃতীদের প্রতিবাদ করায় মাস কয়েক আগে যাঁকে গভীর রাতে বাড়ির সামনে থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করে রেললাইনের ধারে ফেলে রাখা হয়েছিল।

নগরউখরা মোড়ে তল্লাশি।

সৌরভের বাড়িতে ঢোকার রাস্তার মুখে যশোহর রোডে দেখা গেল কয়েক জন যুবক লাঠি হাতে রাত পাহারা দিচ্ছেন। কেউ কেউ সড়কের পাশে যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে বসে। তাঁদেরই একজন অবশ্য জানালেন, ইতিমধ্যেই তিন বার পুলিশ এসে ঘুরে গিয়েছে। বামনগাছি মোড় পেরিয়ে দত্তপুকুরের দিকে এগোতেই দেখা গেল সড়কের একধার দখল করে সারি সারি দাঁড়িয়ে রয়েছে ট্রাক। পাশ থেকে হুশ করে বেরিয়ে গেল একটি গরু-ভর্তি পাচারের ট্রাক। একটি বারের সামনে অন্ধকারের মধ্য বেশ কয়েক যুবকের জটলা থেকে হাসিঠাট্টার শব্দ ভেসে আসছিল। নরসিংহপুর চৌমাথা এলাকায় দেখা গেল, সড়কের দু’ধার দখল করে প্রচুর ট্রাক দাঁড়িয়ে। রাস্তা একেবারেই সরু হয়ে গিয়েছে। একটু এগোতেই চোখে পড়ল একটি ধাবার সামনে চলছে মদ্যপদের হল্লাবাজি। বাইক নিয়ে টলতে টলতে এক যুবক সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে ফোনে কাউকে ডাকছিলেন। কারণ তত ক্ষণে আর বাইক চালানোর মতো ক্ষমতা নেই তাঁর। রাত ১২টা ৪৫ মিনিট নাগাদ দত্তপুকুর হাটখোলা এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, সড়কের পাশে দু’টি এটিএমে কোনও রক্ষী নেই। দোকানপাট বন্ধ। তবে দেখা মিলল না পুলিশ বা আরজিপার্টির। রাত ১২টা ৫১ মিনিটে বিড়া চৌমাথাতেও একই ছবি। গাড়ি থেকে নেমে ছবি তোলা শুরু হলে বারাসতের দিক থেকে দ্রুত গতিতে একটি ট্রাক এসে পিছনের দিকে কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে পড়ল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ট্রাকে গরু রয়েছে। পাচারের জন্য যাচ্ছে সীমান্তে। হঠাৎই নম্বরপ্লেটহীন মোটরবাইকে চড়ে হই হই করতে করতে পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল চার যুবক।

বিড়া চৌমাথা থেকে গুমা চৌমাথা পর্যন্ত পথে যান চালক থেকে সাধারণ মানুষ সকলেই রাতে যেতে ভয় পান। মোটরবাইক ছিনতাই-সহ কত যে ঘটনা এই এলাকায় ঘটেছে, তার ইয়ত্তা নেই। এই দূরত্বটুকুতে আলো একেবারে নেই বললেই চলে। দু’দিকে দিগন্ত বিস্তৃত খেত। সড়কের পাশ দিয়ে ঘন ডালপালা মেলেছে বড় বড় গাছ। চোখে পড়ল না পুলিশের গাড়ি। চালকেরা এই পথ দিয়ে একটু দ্রুতই গাড়ি চালান। এ দিনও তার ব্যতিক্রম চোখে পড়ল না। দূর থেকে ছুটে আসা গাড়িগুলি ডিপারও করে না।

রাস্তার পাশে ট্রাকের সারি। নরসিংহপুরে।

রাত ১টার সময় গুমা চৌমাথায় এসে দেখা গেল আলো নেই। নম্বরহীন বাইক আরোহীদের আনাগোনা বাড়ল। কেউ কেউ বাঁকা চোখে দেখতে দেখতে চলে গেল। খোশদেলপুর বাজারের পর থেকে অবশ্য দেখা গেল সড়কের দু’পাশ আলোয় ঝলমল করছে। ত্রিফলা থেকে ভেপার-সহ কয়েক ধরনের আলো লাগানো হয়েছে। রাত ১টা ১০মিনিট নাগাদ রেলগেট পেরিয়ে অশোকনগরের বিল্ডিংমোড়ে এসে দেখা গেল, সড়কের পাশে পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে। এই প্রথম আমাদের যাত্রাপথে পুলিশের গাড়ি দেখতে পেয়ে বুকে সাহস পেলাম। কিন্তু ছবি তুলতে গেলেই ঝড়ের বেগে গাড়িতে উঠে এলাকা ছাড়লেন পুলিশ কর্মীরা। এলাকার এক যুবক দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেন। একগাল হেসে বললেন, “ট্রাক থেকে টাকা তুলতে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা।”

রাত ১টা ১৫ মিনিট নাগাদ হাবরা শহরের ২ নম্বর রেলগেটে পৌঁছে দেখা গেল, আলোয় ঝকঝক করছে এলাকা। একটি খালি ট্রাক বেপরোয়া ভাবে গাইঘাটার দিক থেকে অশোকনগরের দিকে ছুটে গেল। পুলিশকে কোনও পাত্তাই দিল না। বাসিন্দারা জানালেন, সীমান্তের কোথাও গরু নামিয়ে পালাচ্ছে। চোংদা মোড়ের কাছেও পুলিশি টহল চোখে পড়ল। তবে এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বসিরহাট দক্ষিণ কেন্দ্রে বিধানসভা নির্বাচনের জন্য গরু-ভর্তি ট্রাক ক’দিন ধরে কম আসছে। মধ্যমগ্রামের কাছেই নাকি তাদের আটকে দেওয়া হচ্ছে।

হাবরা থানা এলাকা ছাড়িয়ে আমরা ঢুকে পড়লাম গাইঘাটায়। তখন ঘড়ির কাঁটায় রাত ২টো পেরিয়েছে। কুলপুকুর কালী মন্দিরের কাছে দেখা গেল, টর্চ হাতে এক যুবক সন্দেহজনক ভাবে ঘোরাঘুরি করছে। জলেশ্বর মোড়ে দেখা গেল, দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ গাড়ি। একটু এগোতেই গাইঘাটা বাজার। সেখানে আরজিপার্টির দেখা মিলল। চাঁদপাড়া বাজারে এসে দেখা গেল, কয়েক জন পাচারের ‘লাইনম্যান’ দাঁড়িয়ে।

আলোয় মোড়া হলেও বনগাঁ শহরে নিরাপত্তার তেমন চিহ্ন চোখে পড়ল না। বিএসক্যাম্প মোড় এলাকায় যখন যাত্রা শেষ করলাম, তখন ঘড়িতে ৪টে। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, “যশোহর রোডের নিরাপত্তার বিষয়ে আমরা সব সময়ই বাড়তি সতর্ক থাকি। একই সময়ে হয় তো একই পয়েন্টে পুলিশ থাকে না।”

ছবিগুলি তুলেছেন নির্মাল্য প্রামাণিক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE