Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

চন্দ্রকেতুগড়কে ‘হেরিটেজ জোন’ করার দাবি

মাটির নীচে থাকা সভ্যতার রত্ন ভাণ্ডার লুঠ করছে দুষ্কৃতীরা। চুরি ঠেকাতে কঠোর প্রশাসন নানা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। পুলিশ ইতিমধ্যে দু’চার জন লুটেরাকে ধরেওছে। কিন্তু চুরি ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। প্রত্নসামগ্রী রক্ষার্থে চিন্তিত পুরাতত্ত্ববিদেরা। এলাকার মানুষের দাবি, দেগঙ্গার বেড়াচাঁপায় চন্দ্রকেতুগড় এলাকাকে ‘হেরিটেজ জোন’ ঘোষণা করা হোক।

এই সেই চন্দ্রকেতুগড়।

এই সেই চন্দ্রকেতুগড়।

নির্মল বসু
দেগঙ্গা শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৫ ০২:২৫
Share: Save:

মাটির নীচে থাকা সভ্যতার রত্ন ভাণ্ডার লুঠ করছে দুষ্কৃতীরা। চুরি ঠেকাতে কঠোর প্রশাসন নানা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। পুলিশ ইতিমধ্যে দু’চার জন লুটেরাকে ধরেওছে। কিন্তু চুরি ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। প্রত্নসামগ্রী রক্ষার্থে চিন্তিত পুরাতত্ত্ববিদেরা। এলাকার মানুষের দাবি, দেগঙ্গার বেড়াচাঁপায় চন্দ্রকেতুগড় এলাকাকে ‘হেরিটেজ জোন’ ঘোষণা করা হোক। ওই এলাকা থেকে পাওয়া প্রত্নভাণ্ডার সংগ্রহশালা করে সেখানে সংরক্ষণ করা হোক। যাতে দেশ-বিদেশ থেকে আসা মানুষ দেখতে পান।

চন্দ্রকেতুগড়ের খনা-মিহিরের ঢিবি সংলগ্ন এলাকায় মাটির নীচে ছড়িয়ে রয়েছে বহু মূল্যবান প্রত্ন সামগ্রী। মাটি খুঁড়লেই মেলে এই এলাকার প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন। পুরাতত্ত্ববিদেরা জানিয়েছেন, তার মধ্যে রয়েছে পাল, গুপ্ত, মৌর্য, শুঙ্গ, কুষাণ যুগের পানপাত্র, হাতির শুঁড়, টালি, ইট, পুতুল, মিথুন মূর্তি, নানা আকারের মাটির পাত্র, মুদ্রা এবং বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি। এই প্রত্নসামগ্রীর বাজারদর হাজার হাজার টাকা। বেশ কয়েক বছর ধরে নানা অছিলায় মাটি খুঁড়ে এই সব প্রত্নসামগ্রী কিছু কিছু বিক্রি করছিল একটি মূর্তি পাচার চক্র। কয়েক বছর আগে বেড়াচাঁপায় খনা-মিহিরের ঢিপি এলাকায় একটি বেসরকারি সংস্থার মোবাইল টাওয়ার এবং রাজ্য সরকারের বিদ্যুতের টাওয়ার বসানোর জন্য মাটি খুঁড়তেও বেরিয়ে আসতে থাকে নানা প্রত্নসামগ্রী। এলাকাতে হইচই পড়ে যায়। তা জানতে পেরে পুরাতত্ত্ব বিভাগের তরফে বেড়াচাঁপায় চন্দ্রকেতুগড় এলাকায় প্রশাসনিক নির্দেশে মাটি খোঁড়ার উপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করে বিজ্ঞপ্তি লাগানো হয়। কিন্তু দুষ্কৃতীরা তা মানছে কোথায়? পুকুর কাটা, বাথরুম তৈরির অছিলায় মাটি খুঁড়ে প্রত্নসামগ্রী চুরি করে তা বহু টাকার বিনিময়ে দেশ-বিদেশে পাচার করা হচ্ছে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ।

বেড়াচাঁপা সংগ্রহশালার প্রধান দিলীপ মৈতে।

এই এলাকার প্রত্নসামগ্রীর খোঁজ মিলেছে বহু দিন আগেই। ১৯৫৩ সালে বেড়াচাঁপা হাইস্কুলের কাছে মাঠের মধ্যে বিভিন্ন মূর্তি, পাত্র, ভেড়া ও হাতির মাথা, পুতুলের ভাঙা অংশ পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বেড়াচাঁপা বাজারে টাকি রাস্তার পাশে বাড়ি দিলীপ মৈতের। তিনি সেগুলির কয়েকটা কুড়িয়ে এনে তাঁর বাড়িতে সংরক্ষণ করতে শুরু করেন। এলাকার মানুষ বলতেন, এগুলি চন্দ্রকেতু রাজার জিনিস। মূর্তিগুলির জীবনকথা প্রকাশিত হতে শুরু করে। সংবাদপত্রে সেই খবর প্রকাশ হতে তা দেখতে কলকাতা থেকে আসতে শুরু করেন ইতিহাসবিদেরা। তাঁদের সঙ্গে মাঠে মাঠে ঘুরতেন দিলীপবাবু। ধীরে ধীরে পুরা সামগ্রী সংগ্রহের নেশা জাগে তাঁর। শুরু হয় পুরনো মূর্তি নিয়ে বাড়িতে সংগ্রহশালা করার ইচ্ছা। আবিষ্কারের নেশায় পাগল দিলীপবাবু কুড়িয়ে পাওয়া মূর্তি, মাটির পাত্র, হাতির শুঁড় তুলে দেন কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালার তৎকালীন সহ-অধ্যক্ষ পরেশচন্দ্র দাশগুপ্তের হাতে। দিলীপবাবুর ধ্যানজ্ঞান একটাই চন্দ্রকেতুগড়কে দেশ তথা বিশ্বের দরবারে তুলে দেওয়া। তাঁর বাড়ির সংগ্রহশালায় বেড়াচাঁপায় চন্দ্রকেতুগড় থেকে উদ্ধার হওয়া মৈথুনরত নর-নারীর মূর্তি, গৌতম বুদ্ধ, পোড়া মাটির ফলক, টেরাকোটার যক্ষিণী মূর্তি, লাল পাথরের বুদ্ধমূর্তি, নানা সময়ের মুদ্রা, মাটির পাত্র, হাড়ের উপর করা নকশা, মূল্যবান পাথর দেখতে দূর-দুরান্ত থেকে আজও মানুষ আসে।

দিলীপবাবু বলেন, ‘‘প্রায় দু’হাজার বছর আগে গুপ্ত যুগের মূল্যবান সামগ্রীর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। দুষ্কৃতীরা সেই সব মূল্যবান সামগ্রী মাটি খুঁড়ে লুঠ করে চড়া দামে বিক্রি করছে। এ সব অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের কাছে দাবি, বেড়াচাঁপা এলাকাকে হেরিটেজ জোন ঘোষণা করে একটা মিউজিয়াম করতে হবে। সেখানে থাকবে চন্দ্রকেতুগড় থেকে পাওয়া প্রাচীন নিদর্শন।’’

এ বিষয়ে বারাসাতের সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার বলেন, ‘‘এ বিষয়ে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের সাথে আলোচনা করেছি। মিউজিয়াম তৈরির জন্য জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে। যাঁদের কাছে প্রত্ন সামগ্রী আছে, তাঁরা যদি লিখিত ভাবে আবেদন করেন, তা হলে মিউজিয়ামের কাজ শুরু করতে সুবিধা হবে।’’

দিলীপবাবু জানান, মাঠে-ময়দানে কুড়িয়ে পাওয়া মূর্তিগুলির ইতিহাস নিয়ে নানা জল্পনার পর এক দিন শুরু হয় খনা-মিহিরের ঢিবি খনন। সেটা ১৯৫৮ সাল। খনা-মিহিরের ঢিপিতে আবিষ্কার হয় গুপ্ত রাজাদের সময়ের এক মন্দির। কুঞ্জগোবিন্দ গোস্বামী বেড়াচাঁপায় উৎখনন করেন। খননকার্যে হাত বাড়িয়ে দেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ মিউজিয়ামের অধ্যক্ষ দেবপ্রসাদ ঘোষও। চন্দ্রকেতুগড়ের মাটি সরতেই বেরিয়ে পড়তে শুরু করে জীবজন্তুর মূর্তি। ব্রাহ্মী হরফে লেখা লিপি। সোনা, রুপো এবং তামার টাকা। পুতুল, টেরাকোটার মূর্তি, মাটির কলসি, কাঠের উপর কারুকাজ, দেবদেবীর মূর্তি সহ নানা প্রত্ন সামগ্রী। কলকাতার বরাহনগরের বাসিন্দা পূর্ত বিভাগের কর্মী প্রভাস সোম কাজের প্রয়োজনে বেড়াচাঁপায় থাকতেন। ওই সময়ে তিনি এক দিন রাস্তা খোঁড়ার কাজের সময়ে একটি সূর্য মূর্তি পান। প্রভাসবাবু সেই মূর্তি নিয়ে যান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালায়। মূর্তিটি দেখে বিস্মিত হন ইতিহাস গবেষকেরা।

গত ১৯৫৬-৫৭ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় চন্দ্রকেতুগড় খননের প্রয়াস। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালা এখানে উৎখনন করে পাওয়া খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের প্রাগমৌর্য যুগ থেকে দ্বাদশ শতকের সেন যুগ পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক পর্বের নিদর্শন উন্মোচিত করে। সব থেকে চমকপ্রদ আবিষ্কার হল একটি বহু কোণ বিশিষ্ট ইটের উত্তরমুখী মন্দির। প্রাথমিক ভাবে মন্দিরটি গুপ্ত যুগের বলে অনুমান করা হলেও বাস্তবিক পক্ষে নকশা স্থাপত্য বিন্যাস ও অলঙ্করণের নিরিখে এটি পাল যুগের দেবালয় বলেই মনে হয়। টিপি খননের ফলে সুপ্রাচীন কালের বুদ্ধ মূর্তি, পোড়ামাটির ফলক, শীলমোহর, বিভিন্ন ধাতুর মুদ্রা, স্তুপ এবং নানা ধরনের পুঁতি উদ্ধার হয়েছে।

চন্দ্রকেতুগড়ের একটা অংশ হাড়োয়ার দিকে যাওয়ার রাস্তায় হাদিপুর গ্রামে আছে। যার বেশির ভাগ খননকার্য না হওয়ায় এই ঐতিহাসিক গুরুত্বের বিষয়টি আজও ঠিক মতো জানা যায়নি। তবে ওই এলাকাতে অনেক দিন থেকে মাটি খুঁড়ে মূল্যবান প্রত্নসামগ্রী লুঠের কারবার চালাচ্ছে এক দল দুষ্কৃতী। খনা-মিহিরের ঢিবির চারধার তারকাঁটা দিয়ে ঘিরে সেখানে নোটিস বোর্ড লাগিয়ে পাহারার ব্যবস্থা করে প্রত্ন বিভাগ। কিন্তু এলাকাবাসীর অভিযোগ, প্রশাসনিক সমস্ত নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে দুষ্কৃতীরা রাতের অন্ধকারে মাটি খুঁড়ে প্রত্নসামগ্রী তুলে নিয়ে যাচ্ছে।

ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE