Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

মেয়েদের স্কুল-কলেজের সামনে ভিড় রোমিওদের

চকরা-বকরা কলার তোলা জামা। চোখে বাহারি সানগ্লাস। আঁটোসাঁটো জিনস পরিহিত সদ্য গোঁফের রেখা ওঠা ছোকরা মোটর বাইক নিয়ে চক্কর কাটছিল আগু-পিছু। কেউ ছুড়ে দিচ্ছিল প্রেমের প্রস্তাব। মুখে বুলি নেই, শুধু আকার-ইঙ্গিত ভরসা কোনও কোনও বীরপুঙ্গবের। স্কুলে যাতায়াতের পথে এই সব দৃশ্যের সাক্ষী থাকতে হয় মেয়েদের।

অঙ্কন: নির্মাল্য প্রামাণিক।

অঙ্কন: নির্মাল্য প্রামাণিক।

সীমান্ত মৈত্র
বনগাঁ শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০২:১৬
Share: Save:

চকরা-বকরা কলার তোলা জামা। চোখে বাহারি সানগ্লাস। আঁটোসাঁটো জিনস পরিহিত সদ্য গোঁফের রেখা ওঠা ছোকরা মোটর বাইক নিয়ে চক্কর কাটছিল আগু-পিছু। কেউ ছুড়ে দিচ্ছিল প্রেমের প্রস্তাব। মুখে বুলি নেই, শুধু আকার-ইঙ্গিত ভরসা কোনও কোনও বীরপুঙ্গবের।

স্কুলে যাতায়াতের পথে এই সব দৃশ্যের সাক্ষী থাকতে হয় মেয়েদের। কেউ সবে কৈশোরে পা রেখেছে, কেউ একটু বড়। গায়ে শাড়ির আঁচল টেনে নিয়ে অধোবদনে পা চালিয়ে কেউ ঢুকে পড়ল স্কুলের গেটের ভিতরে। কয়েকটা ঘণ্টা শান্তি। ফেরার পথে আবারও সহ্য করতে হবে ‘সড়কছাপ’ রোমিওদের বেয়াদপি।

এটা এক রকম মেনে নিয়েছে বনগাঁর বহু স্কুলের মেয়েরা। কলেজেও একই অবস্থা।

তবে মঙ্গলবার আনন্দবাজার খোঁজ-খবর করছে শুনেই টনক নড়েছে পুলিশের। এ দিন বিকেলেই দুই রোমিও গ্রেফতার হয়েছে বলে জানিয়েছেন বনগাঁয় সদ্য নিযুক্ত এসডিপিও অনিলকুমার রায়। স্কুলগুলির সামনে নিয়মিত নজরদারি থাকবে বলে আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি। কিন্তু প্রশ্ন হল, সমস্যা তো আজকের নয়। বরাবরের। কোনও বড় ঘটনা না ঘটলে কি নড়ে বসবে না পুলিশ-প্রশাসন?

উত্তর মেলে না। তবে কানে আসে নানা ঘটনার কথা।

স্কুল ছুটির পরে দশম শ্রেণিতে পড়া মেয়েটি যশোর রোডে এসেছিল বাড়ি ফিরবে বলে। একটু দূরে মোটরবাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে তিন যুবক। মেয়েটিকে দেখতে পেয়েই তারা দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকে। নিজেদের মধ্যেই বলাবলি করে, ‘‘চল, ওকে বাসে তুলে দিয়ে আসি।’’ সে কথা শুনে মেয়েটি ভয়ে দৌড় দেয়। বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে যুবকেরা সরে গেলে তারপরে বাড়ি ফেরে। তারপর থেকে মাস দু’য়েক ধরে অভিভাবকদের সঙ্গে আসা-যাওয়া করে স্কুলে।

বনগাঁর বিভিন্ন স্কুলের সামনে স্কুল শুরু আর ছুটির পরে বহিরাগত যুবকদের দাপাদাপি নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। তিতিবিরক্ত শিক্ষক-শিক্ষিকারা। চিন্তায় থাকেন বাড়ির লোকজন। আর আতঙ্কের প্রহর গোনে মেয়ের দল। স্কুলে যাতায়াতের মজাটাই মাটি অনেকের কাছে। দশম শ্রেণির এক ছাত্রী বলে, ‘‘একা সাহস পাই না। সব সময়ে বন্ধুরা মিলে যাতায়াত করি। ওরা কেন যে এমনি বিরক্ত করে আমাদের!’’

মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টা। বনগাঁর শক্তিগড় হাইস্কুলের সামনে গিয়ে দেখা গেল, পাশের পিচের রাস্তা দিয়ে ছাত্রীরা স্কুলে আসছে। নম্বরপ্লেটহীন একটি বাইক জোরে চালিয়ে প্রায় তাদের গা ঘেঁসে চলে গেল। তিন যুবক বসে। একটু এগিয়ে তারা বার বার পিছন দিকে তাকাচ্ছে। বাইকের গতি শ্লথ।

স্কুলের সামনে আরও কিছুক্ষণ থেকে দেখা গেল, মোটরবাইক- সাইকেলে অনেক ছেলে টহল দিচ্ছে। স্কুলের পাশে একটি মাঠে কয়েকজন মোটরবাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে। দেখা গেল, বাইকে করে দুই যুবক যেতে যেতে একদল ছাত্রীর দিকে কিছু একটা মন্তব্য ছুড়ে দিয়ে গেল।

দুপুরে টিফিনের সময়ে স্কুলের গেটের সামনেও বহিরাগতদের ভিড়। স্কুলের কাছে একটি চায়ের দোকানের মালিক বললেন, ‘‘আমার দোকানে সামনে কোনও ছেলে এলে আমি দাঁড়াতেই দিই না।’’ কিন্তু তাতে আর কতটা আটকানো যায় উপদ্রব। স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রদীপ সরকার বলেন, ‘‘বহিরাগত যুবকদের জন্য স্কুলের পঠনপাঠন ব্যাহত হচ্ছে। সকালে স্কুলে এসে আমার ও অন্য শিক্ষকদের প্রথম কাজ হল, ওই সব যুবকদের তাড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু সব সময়ে তা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। পুলিশ-প্রশাসনকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। কিন্তু সে ভাবে পুলিশের দেখা পাওয়া যায় না।’’

পেট্রাপোল সীমান্তের দিকে যশোর রোড ধরে যাওয়ার পথে রয়েছে ছয়ঘরিয়া ঠাকুর হরিদাস উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, স্কুলের কাছে যুবকদের জটলা। এখানেও বাইক নিয়ে ছেলেদের ঘুরতে দেখা গেল। স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, স্কুল শুরু ও ছুটির পরে বহিরাগত যুবকেরা ছাত্রীদের পিছু নেয়। প্রস্তাবে সাড়া না পেলে ওরা তাদের বিরক্ত করে।’’ প্রধান শিক্ষিকা অনিমা চৌধুরী (সাউ) বলেন, ‘‘অভিভাবকেরা আমাদের কাছে এসে অভিযোগ করেন। এই কারণে অনেক ছাত্রীর স্কুলে আসা অনিয়মিত হয়ে যায়। আগে স্কুলের সামনে সিভিক ভলান্টিয়ার মোতায়েন ছিল। পুলিশি টহলও ছিল। এখন তা আর নেই।’’

বনগাঁর বাটার মোড়ের কাছে অন্যতম নামী স্কুল কুমুদিনী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। এখানকার মেয়েরাও স্কুলে আসা যাওয়ার পথে কটূক্তি শুনে অভ্যস্ত। মাঝে মধ্যে স্কুলের সামনে রাস্তার উল্টো দিকে রোমিওরা দাঁড়িয়ে থাকে। এক অভিভাবক মেয়েকে স্কুলে দিতে এসে বললেন, ‘‘আমার মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। কিছু দিন আগেও বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে আসত। সম্প্রতি একটি ছেলে আমার মেয়েটাকে খুব বিরক্ত করছে। তাই বাধ্য হয়ে আমি ওকে স্কুলে দিতে-নিতে আসি।’’ বেশ কিছু অভিভাবকই এখন আর মেয়েদের একা ছাড়ছেন না বলে জানালেন তিনি। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা শম্পা বক্সি বলেন, ‘‘পুলিশকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।’’

তবে রোমিওদের বাড়বাড়ন্তের পিছনে ছাত্রীদের একাংশের ভূমিকাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একটি স্কুলের এক শিক্ষিকা জানালেন,‘‘ রাস্তার পাশের শ্রেণি কক্ষে বড় ক্লাসে পড়া মেয়েরা এসে রাস্তার ছেলেদের দিকে হাত নাড়ে। খবর পেলেই অবশ্য আমরা কড়া ব্যবস্থা নিই।’’ অনেকে কারও সঙ্গে প্রেম করে। অন্যত্র দেখা করার সুযোগ না থাকায় স্কুলে আসা যাওয়ার পথে প্রেমিক যুবক স্কুলের সামনে এসে ভিড় করে। নিউ বনগাঁ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় বা গৌরীসুন্দরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও স্কুলে আসা যাওয়ার পথেও কটূক্তি সহ্য করে বলে জানা গেল।

বনগাঁ শহরের একমাত্র কলেজ দীনবন্ধু মহাবিদ্যালয়। রোজ দূরদূরান্ত থেকে বহু মেয়ে এখানে পড়তে আসে। বনগাঁ টাউনহল মোড়ে বাস বা অন্য যানবাহন থেকে নেমে অনেকেই প্রায় এক কিলোমিটার পথ হেঁটে কলেজে যান। কেউ কেউ ভ্যানেও যান।

মঙ্গবার বেলা ১টার সময়ে ওই রাস্তা দিয়ে ভ্যানে করে কলেজে যাচ্ছিলেন কয়েকজন ছাত্রী। পিছন থেকে দেখা গেল, একটি বাইকে থাকা দুই যুবক জোরে জোরে হর্ন দিচ্ছে। তরুণীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা আর কী! মেয়েরা পিছন ঘুরে না দেখায় বাইকটি ভ্যানের পাশে চলে গিয়ে গতি কমিয়ে দিল। কিছু মন্তব্য ভাসিয়ে দিয়ে উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল।

দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রী বলেনস ‘‘কলেজে আসা-যাওয়ার পথে বহিরাগত ছেলেরা কটূক্তি, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গী করে। বহুবার আমার সঙ্গে এই ঘটনা ঘটেছিল। একবার তো প্রায় ওড়না ধরে টানে আর কী!’’ বনগাঁ দীনবন্ধু মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক সুপ্রিয় দেবনাথ বলেন, ‘‘ছাত্রীরা আমাদের জানালে আমরা পদক্ষেপ করি।’’ রাস্তায় পুলিশ যে একেবারে থাকে না, তা নয়। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় বেশ কম, জানালেন শিক্ষিক-শিক্ষিকারা।

এক অভিভাবিকার কথায়, ‘‘তা-ও তো আজ পুলিশ ধরপাকড় করল। এদ্দিন তা হলে কী করছিল!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE