Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

পুরপ্রধানের পদ নিয়ে টানাপড়েন

এত দিন ছিল ভোটে জেতার অঙ্ক। এ বার পুরপ্রধান হওয়ার লক্ষে নানা চোরাস্রোত বইছে তৃণমূলের অন্দরে। যা কোথাও কোথাও নেতৃত্বের কাছে বেশ মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সরকারি ভাবে এখনও পুরবোর্ড গঠনের দিনক্ষণ ঘোষণা করা হয়নি। তা বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকারও সময় নেই। পুরপ্রধান পদের দাবিদারেরা নিজের মতো করে এখন ঘুঁটি সাজাতে ব্যস্ত।

সীমান্ত মৈত্র
অশোকনগর-কল্যাণগড় শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৫ ০১:৫৯
Share: Save:

এত দিন ছিল ভোটে জেতার অঙ্ক। এ বার পুরপ্রধান হওয়ার লক্ষে নানা চোরাস্রোত বইছে তৃণমূলের অন্দরে। যা কোথাও কোথাও নেতৃত্বের কাছে বেশ মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সরকারি ভাবে এখনও পুরবোর্ড গঠনের দিনক্ষণ ঘোষণা করা হয়নি। তা বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকারও সময় নেই। পুরপ্রধান পদের দাবিদারেরা নিজের মতো করে এখন ঘুঁটি সাজাতে ব্যস্ত। নিজের পক্ষে বেশি সংখ্যক কাউন্সিলরের সমর্থন আদায়ের নানা রকম চেষ্টা শুরু হয়েছে। দলের উপর মহলের সঙ্গে ঘনঘন যোগাযোগ রক্ষা করছেন অনেকেই।

অশোকনগর-কল্যাণগড়, গোবরডাঙা ও বনগাঁ পুরসভায় এ বার বেশিরভাগ আসনে জয়ী হয়েছে শাসক তৃণমূল। ওই তিনটি পুরসভার ক্ষমতাতে ছিল শাসক দলই। তিনটি পুরসভার বিদায়ী পুর প্রধানেরা এ বারও ভোটে জয়লাভ করছেন। স্বাভাবিক ভাবেই বিদায়ী পুরপ্রধানদেরই ফের পুরপ্রধানের পদে বসার কথা। কিন্তু রাজনীতির হিসাব কখনও পাটিগণিতের নিয়ম মেনে চলে না। রাজনীতির সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ চলছে সে কারণেই।

অশোকনগর-কল্যাণগড় পুরসভার ২৩টি আসনের মধ্যে তৃণমূল এ বার পেয়েছে ১৮টি আসন। সিপিএম পেয়েছে ৫টি আসন। গত পুরভোটে ২২টি আসনের মধ্যে তৃণমূল পেয়েছিল ২০টি আসন। পুরপ্রধান হয়েছিলেন সমীর দত্ত এবং উপ পুরপ্রধান হয়েছিলেন প্রবোধ সরকার। পুরপ্রধান হওয়া নিয়ে গতবারও বিস্তর জলঘোলা হয়েছিল এই পুরসভায়। দলীয় সূত্রের খবর, বারাসতের সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদারের ‘উদ্যোগে’ সে বার পুরপ্রধানের শিকে ছিঁড়েছিল সমীরবাবুর ভাগ্যে। প্রবোধবাবুকে উপ পুরপ্রধানের পদ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। সে সময় জেলা রাজনীতিতে কাকলিদেবীর প্রভাব ছিল অনেকটা বেশি। প্রবোধবাবু এলাকায় তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। গতবার পুরবোর্ড গঠনের সময়ে জ্যোতিপ্রিয়বাবু ছিলেন জেলার পর্যবেক্ষক। সমীরবাবু না প্রবোধবাবু কে হচ্ছেন অশোকনগর-কল্যাণগড় পুরসভার পরবর্তী পুরপ্রধান, তা নিয়ে এখন অশোকনগরের রাজনীতি সরগরম। দু’জনে এ বারও ভোটে জয়লাভ করেছেন। দু’জনেই এ বারও পুরপ্রধান পদের দাবিদার।

তাঁরা যে ফের পুরপ্রধান হতে চান, তা প্রকাশ্যে জানাচ্ছেনও দু’জনে। আবার সমীরবাবুর সঙ্গে প্রবোধবাবুর বিরোধের কথা অশোকনগর-কল্যাণগড় পুরএলাকায় কান পাতলেই শোনা যায়। এ বার পুরভোটে প্রার্থী বাছাই নিয়েও দু’জনের বিরোধ প্রকাশ্যে এসেছিল। প্রার্থী বাছাই নিয়ে আলোচনা সভায় দলীয় নেতৃত্বের উপস্থিতিতে দু’পক্ষের অনুগামীরা প্রকাশ্যেই হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। দলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, জয়ী হলে পুরপ্রধান পদে কে কাকে সমর্থন করবেন, তা-ই ছিল ওই সভায় গোলমালের মূল কারণ। ভোট প্রচারে একে অন্যের অনুগামী প্রার্থীকে হারাতে তৎপর ছিল বলে উভয় শিবিরের প্রার্থীদের মধ্যে ক্ষোভও রয়েছে।

তৃণমূলের অন্দরের খবর, কাউন্সিলরেরা দুই শিবিরে বিভক্ত। দুই কাউন্সিলর এখনও পর্যন্ত নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেননি। প্রবোধবাবুর মাথায় রয়েছে বিধায়ক ধীমান রায়ের ‘আর্শীবাদের’ হাত। প্রবোধবাবু যাতে পুরপ্রধান হতে পারেন, সে জন্য ধীমানবাবুর প্রচ্ছন্ন মদত রয়েছে। দু’জনের মধ্যে নিয়মিত আলাপ-আলোচনা চলছে। যদিও ধীমানবাবুর কথায়, ‘‘পুরপ্রধান কে হবেন, তা জেলা পার্টি নেতৃত্ব ঠিক করবেন।’’ দলের স্থানীয় এক নেতার কথায়, ‘‘গত পাঁচ বছরে পুরসভা পরিচালনার ক্ষেত্রে সমীরবাবুর কিছু দুর্বলতা ও কাজকর্ম সম্পর্কে দলের উপরতলার নেতারা সন্তুষ্ট নন। পাশাপাশি সাংসদ কাকলিদেবী এ বার পুরপ্রধান কে হবেন, সে বিষয়ে এখনও পর্যন্ত নীরব।’’ এ বার সমীরবাবুর ‘লাইফ লাইন’ হয়ে সাংসদের আসরে নেমে পড়ার সম্ভাবনাও কম বলে জানাচ্ছে দলের একটি সূত্র। কারণ, গত লোকসভা ভোটের পর থেকে কাকলিদেবী তাঁর সাংসদ এলাকায় দলীয় সংগঠনের বিষয়ে আগের মতো সক্রিয় নন। এই পরিস্থিতিতে প্রবোধবাবু ইতিমধ্যেই পুরপ্রধান হতে চেয়ে জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ও দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বক্সির সঙ্গে দেখা করে সে কথা জানিয়েও এসেছেন। প্রবোধবাবু বলেন, ‘‘পুরপ্রধান হওয়ার দাবি আমার রয়েছে। দল আমাকে যোগ্য মনে করলে পুরপ্রধান হতে আমার আপত্তি নেই।’’

অন্য দিকে, পুরপ্রধান হওয়ার মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সমীরবাবুও। তাঁর শিবিরের এক কাউন্সিলরের দাবি, ইতিমধ্যেই নাকি ন’জন কাউন্সিলর সমীরবাবুর কাছে লিখিত ভাবে তাঁকে পুরপ্রধান করার ব্যাপারে সম্মতি জানিয়ে দিয়েছেন। তবে সমীরবাবুর কাছে কাউন্সিলরেরা নানা দাবি করেছেন সমর্থনের বিনিময়ে। তা ছাড়া, পুরভোটে এ বার সমীরবাবুকে সামনে রেখে সাফল্য পেয়েছে দল। গতবারের থেকে দু’টি আসন এ বার কম পেলেও শতাংশের হিসাবে তৃণমূলের ভোট লোকসভার তুলনায় বেড়েছে। সমীরবাবু বলেন, ‘‘কে পুরপ্রধান হবেন সেটি ঠিক করবেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এখানে তৃণমূলের মধ্যে কোনও সমস্যা নেই।’’

জ্যোতিপ্রিয়বাবু বলেন, ‘‘অশোকনগর-কল্যাণগড়ে কে পুরপ্রধান হবেন, তা কাউন্সিলরেরা ঠিক করবেন। তা ছাড়া, বিধায়কের মতামতকেও গুরুত্ব দেওয়া হবে।’’ যেহেতু জ্যোতিপ্রিয়বাবুর সঙ্গে প্রবোধবাবুর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে, তাই অনেকেই ভাবতে শুরু করেছেন প্রবোধবাবুই হয় তো এ বার পুরপ্রধান হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে। কারণ পুরপ্রধান পদে কে বসবেন, তা নিয়ে দলের জেলা সভাপতির একটা ভূমিকা থাকবেই। যদিও জ্যোতিপ্রিয়বাবু এমন সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিচ্ছেন।

গোবরডাঙায় পুরভোটে তৃণমূল এ বার মোট ১৭টি আসনের মধ্যে জয়ী হয়েছে ১৩টি আসনে। বিদায়ী পুরপ্রধান সুভাষ দত্তও জয়ী হয়েছেন। এখানে অবশ্য পুরপ্রধান হিসাবে দ্বিতীয় কোনও নাম এখনও পর্যন্ত প্রকাশ্যে শোনা যায়নি।

বনগাঁয় পরিস্থিতি একটু অন্য রকম। ২২টি আসনের মধ্যে তৃণমূল পেয়েছে ১৯টি। দলীয় সূত্রের খবর, এখানে এখনও পর্যন্ত পুরপ্রধান হিসাবে দু’টি নাম শোনা যাচ্ছে। এক জন বিদায়ী পুরপ্রধান জ্যোৎস্না আঢ্য। অন্য জন বনগাঁ শহর তৃণমূল সভাপতি তথা জ্যোৎস্নাদেবীর স্বামী শঙ্কর আঢ্য। তৃণমূলের অন্দরের খবর, পুরপ্রধান যিনিই হোন না কেন, তা যে আঢ্য পরিবার থেকেই হচ্ছে, তা এক রকম নিশ্চিত। জয়ী ১৭ জন কাউন্সিলর রবিবারই পুরপ্রধান হিসাবে শঙ্করবাবুকে চান বলে কাগজে সই করে দিয়েছেন বলে দলের একটি সূত্র জানাচ্ছে। শঙ্করবাবু অবশ্য বলেন, ‘‘পুরপ্রধান ঠিক করবে দল। ওই বিষয়ে আমার মতামত নেই।’’

তবে দলের একটি অংশ আবার চাইছেন জ্যোৎস্নাদেবীকেই ফের পুরপ্রধান করতে। স্থানীয় রাজনীতিতে জ্যোতিপ্রিয়বাবুর স্নেহধন্য বলেই পরিচিতি আছে শঙ্করবাবুর। জ্যোতিপ্রিয়বাবু এ বিষয়ে বলেন, ‘‘বিধায়ক ও স্থানীয় নেতৃত্ব বসে ঠিক করবেন কে পুরপ্রধান হবেন।’’ বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস জানিয়েছেন, জয়ী ১৯ জন কাউন্সিলরই পুরপ্রধান হওয়ার যোগ্য। আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE